নুসরাতের শেষ ইচ্ছা
হাসান কবীর
‘ভাই, আমি বুঝতে পারছি- আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। যদি আমার কিছু একটা হয়ে যায়, মায়ের দিকে খেয়াল রাখবি। আর এই ঘটনার জন্য যে দায়ী, তার যেন বিচার হয়।’
ফেনীর সোনাগাজীতে আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রে বোরকাপরিহিত দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধহয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন নুসরাত জাহান রাফি এভাবেই কাতর স্বরে কথাগুলো বলছিল তার ভাইকে।
ডাক্তার জানিয়েছেন, নুসরাতের শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
ভাই বোনের কথোপকথনের দৃশ্যটা হৃদয়বিদারক। এটাই ছিল নুসরাত এর পরিবারের সাথে সর্বশেষ আলাপ। ১১ এপ্রিল, ২০১৯, বুধবার রাত সাড়ে নয়টায় গোটা শরীরে দগ্ধ যন্ত্রণা নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান নুসরাত । এতদিন আমরা স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে মারামারি, হানাহানির খবর শুনে এসেছি বহুবার। তবে মাদরাসাতে এমন নির্মম, হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আমার মতো অন্যদেরও হয়তো কল্পনাতেও আসেনি। নুসরাতের মৃত্যু দেশের মাদরাসাগুলো সম্পর্কে নতুন করে ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম শিক্ষাই যাদের মূল উদ্দেশ্য, ধর্ম নিয়ে যার নিত্যদিনের আলোচনা সে কেমন করে এমন অধর্মের কাজ করতে পারে? নিজের প্রতিষ্ঠানের সন্তানতুল্য ছাত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার মত এমন নিষ্ঠুর আদেশ মাদরাসার অধ্যক্ষ কেমন করে দিতে পারে? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীরগায়ে আগুন লাগানোর ঘটনা আমাদের দেশে ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে, অন্য কোন জনপদে, এরূপ ঘটনার নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি সভ্যতা থেকে দূরে, গহীন বনে-জঙ্গলে বাস করা আদিবাসীদের মধ্যেও এমন ঘটনা শোনা যায়নি।
মাতা পিতার পরেই শিক্ষকের অবস্থান। মাতা পিতা আমাদেরকে জন্ম দেন। শিক্ষক আমাদের মাঝে জ্ঞানের বীজ বপন করেন। ভালো মন্দের পার্থক্য শেখান। সুপ্ত বিবেক জাগ্রত করেন।
শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, তবে এই মেরুদন্ডের অস্থিমজ্জা হল শিক্ষক। তবে কেন এই বর্বরতা? কোথায় হারালো শিক্ষকের নৈতিকতা? কেন শিক্ষক আজ এতটা পাষণ্ড? এমনকি নিষ্পাপ সন্তানতুল্য ছাত্রীর গায়ে আগুন দিতেও পিতৃতুল্য শিক্ষক আজ দ্বিধাবোধ করছে না। কিন্তু কেন ?
মূর্খ যখন পাপ করে তখন সে পরিণাম না বুঝে, না জেনে পাপ করে। কিন্তু জ্ঞানী? জ্ঞানী পরিণাম জেনে, বুঝে পাপের পথে অগ্রসর হয়। সুচতুরভাবে পাপ করতে থাকে।
অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা সুচতুরভাবে এই জঘন্য কাজটি করেছেন। তবে তিনি এমন জঘন্য, ভয়ানক অপরাধ সর্বপ্রথম করছেন এ কথা বলা যাবে না। লোক চক্ষুর অন্তরালে করা ছোট ছোট পাপগুলো তাকে এমন বৃহৎ, বীভৎস অপরাধ করতে উৎসাহিত করেছে।
তিনি ভেবেছিলেন নুসরাতকে যে কোনোভাবে মারতে পারলেই সমস্ত কিছুই শেষ হয়ে যাবে। তাকে কবর দেওয়ার সাথে সাথে নিজের সমস্ত অপরাধ চিরদিনের জন্য মাটি চাপা পড়বে। নুসরাত ওদের সাথে সাথে তার সাথে কৃত অপরাধগুলো শেষ হবে।
সিরাজউদ্দৌলা সাহেব একবারের জন্যও ভাবেননি নুসরাত যখন মারা পড়বেন, তখনই তিনি হবেন খুনী। আর খুনের অপরাধে তাকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হবে ।
তার হয়তো অনেক ক্ষমতা থাকতে পারে। যে ক্ষমতার উপর পূর্ণ ভরসা করে তিনি এমন জঘন্য পাপ করেছেন। তবে ন্যায় বিচারের কাছে কোন অবৈধ ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। সেটা টাকার হোক, বা পেশিশক্তির। পাপের শাস্তি পাপীকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। শুধু সিরাজউদ্দৌলা সাহেব নয়, তার আশেপাশের সহযোগী সব শক্তির উৎসগুলোকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে । এমন শাস্তি, যা দেখে ভবিষ্যতে পাপীর আত্মা যেন কেঁপে ওঠে। কোন পাপীকে কেউ যেন ভুলেও সাহায্য করতে সাহস না করে। কোন শিক্ষক যেন সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীর সাথে কোন অমানবিক আচরণ করতে ভয় পায়। পাষণ্ডহৃদয় যেন অপরাধ করতে আঁতকে ওঠে।
লেখকের আরো লেখা:
>সুপেয় পানি ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
>স্কুলে শিশুর ও বাড়িতে মায়ের আর্তনাদ
শিক্ষকদের এমন নৈতিকতার অবক্ষয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ। শিক্ষকরা হল সমাজের আদর্শ। সেই আদর্শ যখন এমন জঘন্য কাজে লিপ্ত হয় তখন ধীরে ধীরে সমাজ নিমজ্জিত হবে গাঢ় অন্ধকারে। গহীন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকবে মানুষের বিবেক। সমাজ হবে খারাপ মানুষের আবাসভূমি।
আমার সন্তান, আমার ভাই, আমার বোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন নির্ভয়ে থাকতে পারে। কোন অশুভ কালো ছায়া, কোন পাপীষ্ঠের পাপী হাত যেন তাদের স্পর্শ করতে না পারে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা চাই। এজন্য সরকারকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমন প্রতিটি দায়িত্ববান ব্যক্তিকে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই আমাদের সন্তান, আমাদের ভাই, আমাদের বোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ থাকবে। নুসরাতের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও দাবী জানাই,-'এই ঘটনার জন্য যে দায়ী, তার যেন বিচার হয়।’
এতে নুসরাত এর পিতা-মাতার মনের অবস্থা কী হবে জানি না, তবে নুসরাতের আত্মা একটু হলেও শান্তি পাবে বলা যায়।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্যাংকার
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ১১,২০১৯)