প্রতীক মাহমুদ

মানুষ কখনো সময়কে ভর করে বেড়ে ওঠে। কখনো সময়ের ভেতর থেকে বেড়ে ওঠে। আবার কখনো-বা সময়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠে। যেভাবেই বেড়ে উঠুক না কেন মানুষের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের কর্মকাণ্ডই মূলত তাঁর পরবর্তী জীবনের ভিত নির্মাণ করে। প্রারম্ভিক জীবনের শিক্ষা ও চেতনার গঠনই পরবর্তী সময়ে মানুষকে প্রাজ্ঞ করে তোলে।

আর এই প্রাজ্ঞজনেরাই আলোকবর্তিকা হাতে সময়ের পাশে দাঁড়ান; দাঁড়ান সভ্যতা ও মানুষের পাশে। আবার সমাজ-সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও নিরলস অবদান রেখে চলেন। সত্যিকার অর্থে তাঁদের হাতেই নির্মিত হয় কাল। এমনকি সময়ের আসনে চেপে তাঁরা ইতিহাসেও পৌঁছে যান, হয়ে ওঠেন সময়ের চোখ।

বাংলাদেশের তেমনই ৫২ প্রাজ্ঞজনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের আত্মকথন নিয়ে লেখা সমৃদ্ধশালী বই ‘সেতুবন্ধন’। এই গ্রন্থের মুখ্য প্রয়াসটি হল প্রবীণদের সঙ্গে নবীনদের একটি সেতুবন্ধন গড়া। আমাদের দেশের প্রাজ্ঞ এই নাগরিকদের সময়ের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের মানুষের জীবনাচরণে বড় ধরনের মৌলিক পার্থক্য ঘটে গেছে। তা যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারণের ফলে ঘটেছে, তেমনি ঘটেছে সময়ের চাহিদানুযায়ী। নতুনপ্রজন্মের সঙ্গে সেই পার্থক্য আর গরমিলের বন্ধনই হচ্ছে সেতুবন্ধন। এতে নবীনেরা তাদের নিজ নিজ শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের সমান্তরালে আজকের প্রবীণ কিন্তু প্রাজ্ঞজনদের বেড়ে ওঠার দিনগুলো দেখার সুযোগ পাবেন নিঃসন্দেহে। এই ৫২জন নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তাঁদের নানামুখী অবদানে আমাদের সমাজ ও সভ্যতা ঋদ্ধ।

এখানে শুধু তাঁদের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের সময় উঠে আসেনি, এর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে শুরু করে ষষ্ঠ দশক পর্যন্ত সময়ের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং কর্মেরও একটি ইতিহাস। ভাষা-আন্দোলনের সন সংখ্যাটিকে (১৯৫২) স্মরণ করেই এই গ্রন্থটিতে ৫২জনের আত্মকথন অন্তর্ভুক্ত করেছেন গ্রন্থটির সংকলক বিধান চন্দ্র পাল।

এই ৫২জনের প্রত্যেকেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠে সেই অভিজ্ঞতাকেই পরবর্তী জীবনের পাথেয় করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছেন। তেমনি কয়েকজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্যের খণ্ডচিত্রের কিছু কথা এখানে তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি—

গ্রন্থটির প্রথমদিকে আমরা দেখতে পাই, মাস্টার দা সূর্যসেনের রাজনৈতিক সহকর্মী বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘যেদিন মাস্টার দার সঙ্গে দেখা হল, বললাম, মাস্টার দা আপনি তো জানেন আমি “দেশের কথা” বইটি পড়েছি। আমাদের দেশের যে সব তাঁতী ভালো কাপড় বুনতেন তাদের কাপড় উচ্চদামে বিক্রি হতো। ব্রিটিশ সরকারের লোকজন সেই তাঁতীদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিত। আমরা এই সমস্ত বর্বর লোকদের দেশ শাসন করতে দেব না।’

সেতুবন্ধনে একটি দিক লক্ষ্য করা যায়, যাদের জন্ম বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে, তাঁরা প্রায় সবাই ‘পথের দাবী’, ‘দেশের কথা’ বইগুলো পড়েছেন। যদিও সেই সময় ওই বইগুলো নিষিদ্ধ ছিল। এ ছাড়া প্রাজ্ঞজনদের বেশীর ভাগই মার্ক্সের রাজনৈতিক চেতনার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তারা মার্ক্স-এঙ্গেলসকে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে নিয়েছিলেন। আর এ কারণেই তাঁদের চেতনা গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক ও উদারপথে।

জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জ্ঞানের ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে কোনো কথাই শেষ কথা নয়।’ ছোটবেলা থেকেই শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা এই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘আসলে ইতিহাসের কোনো কথাই শেষ কথা নয়। কোন বিধানই চূড়ান্ত নয়। মুক্তমনের সঙ্গে মুক্ত পরিবেশের সঙ্গে এডজাস্ট করতে হবে। এমনকি মার্ক্সসিজমও শেষ কথা নয়।’

আবার বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিমের সাক্ষাৎকার থেকে বের হয়ে আসে, “তাকে প্রশ্ন করলে ‘কেমন আছেন?’ উনি সব সময় উত্তর দেন ‘কেমনের ম-টা কেটে দাও।’ অর্থাৎ ওনার আত্মজিজ্ঞাসা ‘কেন আছেন?’ তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আছে নাকি জীবন। জীবন আছে বলে জানি না, আমি তো জানি না।”

ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের কাছে তাঁর শিক্ষক হলেন মানুষ। তিনি সেই বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস থেকে বলেন, “ভাষা, সংস্কৃতির জন্য এ দেশের মানুষকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমি কলেজজীবন থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রাম করেছি। যার জন্য আমি ‘ভাষা মতিন’ উপাধী পেয়েছি।”

এই গ্রন্থে যাঁদের আত্মকথন বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের অনেকেরই জন্ম তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায়। আসলে ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায় ছিল বলে সেখানে ওই সময়ের নব্য-শিক্ষিত লোকজন গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য, যুগে সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য। যদিও দেশবিভাগের আগে ও পরে অনেকেই পরিবার নিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় চলে আসেন। আর এই চলে আসার পেছনে কাজ করেছে একটা অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবর্তন।

জাতীয় অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম যথার্থই বলেন, ‘ইতিহাসের পাঠ নাও, আয়না নিজের মুখ দেখো।’ তিনি স্মৃতি হাতড়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, ‘যতটা মনে আছে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের কোলে বসে স্লেটে অ, আ, ক, খ, ১, ২ লেখা শিখি। এ ছাড়া কলকাতার আরেকটা স্মৃতি গড়ের মাঠে ঈদের নামাজ পড়া। পরে যখন শুনলাম নামাজে ইমামতি করেছেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, তখন সেটা আমার কাছে হয়ে ওঠে অহংকারের বিষয়। জীবনের প্রথম ঈদের নামাজের ইমাম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাছে লেখাপড়ায় হাতে খড়ি এই দু’টো আমার জীবনের ঈর্ষণীয় গর্ব।’

অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, যে দায়িত্বটা পালন করব সেটাই যদি ভালোভাবে করতে পারি তবেই দেশের জন্য শ্রেষ্ঠ অবদান রাখা হবে, তাহলেই আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন হবে। কাজেই শিক্ষক হিসেবে আমি যদি শিক্ষকতার কাজটা আমার ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ঠিক মতো করতে পারি তাহলে সেটাই হবে দেশের প্রতি ঋণ শোধ।

দেশের প্রতিথযশা এই প্রাজ্ঞজনের অতীতচারিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। সেটা হল বিখ্যাত মোহাম্মদী পত্রিকার নেপথ্য সম্পাদকের কথা। তিনি পত্রিকায় নিজের লেখা ছাপা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন- ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রথম আমার লেখা ছাপা হয়। আমার ফুপাতো ভাই কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন মোহাম্মদীর নেপথ্য সম্পাদক। তিনিই পত্রিকার সব কাজ করে দিতেন। তবে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম ছাপা হতো না। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হতো মওলানা আকরাম খাঁর।

আর বৃক্ষপ্রেমিক, পরিবেশবিদ, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, শিক্ষক এবং গবেষক দ্বিজেন শর্মা তাঁর যৌবনকালের আত্মকথনে রাশিয়া জীবনের কথা এভাবে তুলে আনেন, ১৯৭৪ সালে যখন রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনায় অনুবাদকের চাকরী পেয়ে গেলাম তখন দ্রুত সেখানে গিয়ে কাজে যোগ দেই। মনে হয়েছিল স্বপ্নের দেশে এসেছি। এমন দেশে আর কোথাও দেখিনি। এ সমাজে কে ইঞ্জিনিয়ার, কে অধ্যাপক, কে শ্রমিক তা চেনার উপায় নেই। তেমন দেশইতো সমাজতান্ত্রিক দেশ।

আবার দেখি স্মৃতিচারণ করতে করতে সংগীতজ্ঞ ও সংগীত গবেষক সুধীন দাশ বলে ফেলেন, শুদ্ধ রাস্তায় শুদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী যারা সংগীত চর্চা করে তারা কিন্তু সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠেন।

বাংলাদেশের বিখ্যাত মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ বদরুদ্দীন উমর বলেন- ‘আমাদের পরিবারে ইংরেজির চর্চা ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছে। অন্যান্য মুসলমান পরিবার তখন ইংরেজি বয়কট করলেও আমাদের পরিবার সে রকম ছিল না। আমার প্র-পিতামহ রামতনু লাহিড়ীর ছাত্র ছিলেন। বর্ধমান থাকাকালে স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিম চন্দ্র বিএ পাস করেছিলেন। যদিও তার আগেরবার ফেল করেছিলেন তিনি।’ উমর আবার অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সারাজীবন চারপাশের যেটা ভালো দেখেছি সেটা গ্রহণ করেছি। যেটা বর্জন করা দরকার সেটা বর্জন করেছি। কাউকে দেবতা মনে করিনি। কাউকে আবার এবসলিউট ভিলেনও মনে করিনি। এই জিনিসগুলো আমি ছোটবেলায় লেখাপড়া চর্চার মধ্য দিয়েই শিখেছি।

এই প্রাজ্ঞজনদের আত্মকথন পড়তে গিয়ে একটা জিনিস নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এদের প্রায় সবাই দেশভাগ-পরবর্তী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কেউ কেউ সময়কে চিড়ে সংগ্রামে নেমেছেন, কেউ আবার সময়কে নিজের ভেতর ধারণ করে ঋদ্ধ হয়েছেন।

কবি গোলাম মোস্তফার পুত্র শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার। বাংলাদেশের পাপেট শিল্পের প্রচার-প্রসারে ও সৃজনশীল বিকাশে যার অবদান অনন্য। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেন— আর্ট কলেজে থাকতে আমার এনিমেশনের প্রতি ভীষণ ঝোঁক হয়েছিল। কারণ হুগলীতে যখন ছিলাম তখন আমি অনেক কার্টুন ছবি দেখেছি। মিকি মাউসের ছবি ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো লাগত। পরবর্তীকালে কি করে এটা করতে হয় তা চেষ্টা করলাম। এই মুস্তাফা মনোয়ার ভাষা আন্দোলনে জেলও খেটেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের সময় ধরা পড়লাম। কেউতো বলে দেয়নি যে, তুমি গিয়ে ধরা দাও। ধরা পড়লাম, একমাস জেলও খাটলাম।’

সিম্পল লিভিং এবং হাই থিংকিংয়ে বিশ্বাস করা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ তার স্মৃতিচারণায় বলে গেছেন— আমার ছেলেবেলার পাঠে জীবনী, আত্মজীবনী অনেক বেশী পড়েছি। এবং সে সময় যে রাজনৈতিক আবহ ছিল তাতে দেশপ্রেম বিষয়টা ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তখনকার রাজনীতিবিদরা দেশের জন্য যা করতেন তা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত। সুতরাং রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হয়েও রাজনীতি সচেতন হওয়ার একটি প্রক্রিয়া আমার মানসমূলে সে সময় কাজ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেছেন, ‘নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী চলো। যদি ভুলও করো তাহলে শুধরে নেওয়ার সময় পাবে, শুধরে নিও।’ তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় ভাষা আন্দোলনের কথা এভাবে তুলে ধরেন, “আমাদের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হওয়া উচিত, তা না হলে আমাদের কি ক্ষতি হবে, এটা সম্পর্কে লিখেছিলাম। আর সেটি পুস্তিকা আকারে বের করেছিল যুবলীগ। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী ও কেন’ এই নাম দিয়ে। এটি ছিল ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম পুস্তিকা।”

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান এবং ষাটের দশক থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন মনে করেন— সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের মধ্যে এখনো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন আছে। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় আমেরিকা সম্পর্কে বলেন, ‘ওই সময় সাধারণত সবাই বিলেত যেতে চাইত। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম আমেরিকায়। কারণ দুই বছরের জন্য ফুল স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। এখন হয়তো লক্ষাধিক মানুষ আছে বাংলাদেশের। কিন্তু তখন পূর্ববাংলা থেকে আমরা মাত্র দশজন ছিলাম আমেরিকায়।’

আসলে এই প্রাজ্ঞজনদের ব্রতই ছিল সমাজ পরিবর্তন করা। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক চেতনাকে পাশ কাটিয়ে তাঁরা একটা সুন্দর ও সুশীল জাতি গঠনে তৎপর ছিলেন। এমনকী তাদের ভেতর আজও সেই চেতনা আছে এবং ভবিষ্যতেই থাকবে। তাইতো এখনো তাঁরা আজকের তরুণদের চোখ দিয়ে সেই অসাম্প্রদায়িক জাতির স্বপ্ন দেখেন।

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তোমার শরীর থেকে দেশের জন্য যতটুকু তুমি দেবে, দেশের ঠিক ততটুকুই হবে।’ তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে আসে— আমার একটা দামী সম্পদ ছিল, যা আমি হারিয়ে ফেলেছি। সেটা হচ্ছে স্মৃতিশক্তি। আমি কোন কিছু একবার পড়লেই তা মোটামুটি মুখস্থ হয়ে যেত। দু’বার পড়লে পুরোপুরি মুখস্থ। পরীক্ষার আগের রাতে আমি ৭ থেকে ৮টি প্রশ্ন মুখস্থ করতে পারতাম। তাই সারা বছর তেমন একটা পড়াশোনা না করলেও পরীক্ষার ফল মোটামুটি ভালো হতো।

‘প্রত্যেকেরই একটা প্রতিবাদী চেতনা থাকা উচিত’ এমনটাই মনে করেন বর্তমান সময়ের আরেক প্রাজ্ঞজন ড. আকবর আলি খান। তিনি তাঁর আত্মকথনে আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু আইসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে তিনিও সেটা হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তিনি আইসিএসে চাকরী করেননি। আবার অনেকেই জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আইসিএস পরীক্ষার জন্য দুইবার বিলেত গিয়েছিলেন। তিনিও আইসিএসে চাকরী করেননি। এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। যদি যেতেন, তাহলে আমরা এত বড় মাপের একজন কবিকে হয়তো পেতাম না।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মনে করেন— সৎ থাকা এবং সততার জায়গাকে ধরে রাখতে পারা মানুষের এবং মূল্যবোধের বড় জায়গা। তিনি তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে সেই ছোটবেলায় ফিরে যান। তাঁর ভাষ্য- ‘লেখালেখির মধ্যে যখন আমি নতুন করে চরিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি, যখন আমি একজন মানুষ খুঁজছি, তখন আমি দেখছি নৌকার মাঝিকে, আমাদের খেয়াঘাটে নৌকা বাইতো। শুকনা, কালো, গলাভাঙা। যখন ঈদের দিন মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে কলাপাতায় জর্দা-সেমাই পেঁচিয়ে তাঁর জন্য নিয়ে যেতাম, সে যে কি খুশি হতো! মানুষের দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং অভাব আমাকে সেই শৈশব থেকে দেখতে হয়েছে এবং আজ পর্যন্তও দেখতে হচ্ছে।

যিনি তরুণদের কাছ থেকে চান ‘মনের ঝকঝকে ভাবটা যেন কখনো মলিন না হয়’ তিনি হলেন কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। তিনি স্মৃতিচারণ করতে করতে একটি তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেন এভাবে, ‘মা (সুফিয়া কামাল) কিন্তু ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন। এটা হয়তো অনেকেই জানেন না। ব্র্যাকটা তৈরী হয়েছে ফজলে হোসেন আবেদ এবং ভিকারুল ইসলাম নামে আরেকজন ভদ্রলোকের উদ্যোগে। কিন্তু মা সেটার প্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন। তিনি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তেই যার লেখনীতে উঠে এসেছিল সায়েন্স ফিকশন তিনি হলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক ও পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপকের প্রথম জীবনের বেড়ে ওঠাটা ছিল খুব সংগ্রামমুখর। তাঁর আত্মকথনে উঠে আসে- ‘আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি তখন বলতে গেলে আমাদের একটা পয়সাও ইনকাম ছিল না। আমার মা যদি না থাকতেন তাহলে আমরা কেউ থাকতাম না। তিনি আমাদের সিংহের মতো বুকে আগলে রেখে রক্ষা করছেন। আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ যখন পাস করে এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটিতে চাকরী নিলেন তখন একটুখানি খরচ এসেছে। আমার মা সেলাইয়ের কাজ করেছেন। আমি টিউশনি করেছি। পত্রিকায় কার্টুন এঁকেছি। লেখালেখি করেছি। নিজের খরচটা নিজে চালিয়েছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মোহাম্মদ মনে করেন, ‘অন্যায় নিপীড়নের বিরোধিতা করা একজন স্বাভাবিক মানুষের বৈশিষ্ট্য।’ তাঁর জীবনের প্রথম দিককার স্মৃতিভাষ্যে তিনি বলেন, ‘৭৩ সালে আমি একটা লেখা লিখলাম এবং সেটা বিচিত্রায় পাঠালাম। লেখাটা ছাপাও হল। লেখার মধ্যে একটা প্রস্তাব ছিল যে, এক বছরের জন্য সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হোক। আর সেই বন্ধকালীন সময়ে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন গ্রামে ও বস্তিতে পাঠাতে হবে; যাতে সেখানে গিয়ে তারা নিরক্ষরতা দূর করতে পারে। এর পাশাপাশি তারা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি দূর করবে এবং কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নেও কাজ করবে। তখন যে অবস্থা ছিল তাতে আমাদের ওটা দরকার ছিল। আমার মনে হয় সেটা ঠিক ছিল।

‘প্রতিটি অভিজ্ঞতা, যাত্রা পথের প্রতিটি পদক্ষেপ জীবনের এক একটি অর্জন’ এমনটাই মনে করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সংগীত জীবনের বাইরেও তাঁর রাজনৈতিক স্মৃতি বর্ণনা করেন এভাবে- ‘৬৮/৬৯ সালে যখন গণ-আন্দোলন শুরু হয়, তখন স্কুল থেকে আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ছাত্রনেতা ছিলেন। আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা স্কুলে একটা বাস নিয়ে এসেছিলেন ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁর বোন শেখ রেহেনা ওই স্কুলে পড়তো। পরে বাসে করে আমরা সবাই মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই প্রথম আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া।

এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের আত্মকথন উঠে এসেছে সেতুবন্ধনে। এদের মধ্যে রয়েছেন ভাষা সৈনিক লতিফা আকন্দ, হালিমা খাতুন, শিল্পপতি আব্দুল মোনেম, জাতীয় অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাদত হুসাইন, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আবুল মকসুদ, সুজন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক এম এম আকাশ, যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ প্রমুখ। যদিও এরাই শুধুমাত্র সমসাময়িক বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ ও প্রবীণদের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। এর বাইরে আরও অনেকেই আছেন, যাদের বেড়ে ওঠার সময়টা তুলে আনা প্রয়োজন। আর এই আয়োজনটা যে পরিপূর্ণ এ কথা বলা যাবে না। সম্পাদনার ক্ষেত্রে অসংগতি রয়ে গেছে। সময় নিয়ে কাজ করলে বাক্য গঠনের অসংগতিগুলো দূর করা যেত। এ ছাড়া রয়েছে বানান প্রমাদও। এত বড় ধরনের কাজে সেটা থাকা উচিত নয়। যা হোক, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ যে প্রাজ্ঞজনেরা এই গ্রন্থ থেকে বাদ পড়েছেন পরবর্তীকালে তাদের আত্মকথন সংযোজন করে বিধান চন্দ্র এর কলেবর বৃদ্ধি করবেন বলে আশা করছি। এর পর সুন্দর সম্পাদনা ও বানান প্রমাদমুক্ত আরও সমৃদ্ধ একটা গ্রন্থ পাব বলেই আমাদের বিশ্বাস।

সব শেষে বলা যায়, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মহীরুহরূপ ব্যক্তিত্ব হিসেবে যারা আমাদের চিরচেনা, তাদের সোনালী শৈশব, চপল-চঞ্চল কৈশোর ও দূরন্ত যৌবনের খণ্ডিত উপস্থাপনাই এই আত্মকথন। প্রবীণ-প্রাজ্ঞজনদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রেরণা পাবে আজকের তরুণেরা। আর সে ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি নবীন ও প্রবীণদের প্রজন্মগত সেতুবন্ধন হয়ে থাকবে।

[[ সেতুবন্ধন ।। কতিপয় প্রাজ্ঞজনের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের আত্মকথন; সংকলক ।। বিধান চন্দ্র পাল; প্রচ্ছদ ।। ধ্রুব এষ, মূল্য ।। ৮০০ টাকা; পৃষ্ঠা সংখ্যা ।। ৬৩০; অবসর প্রকাশনা সংস্থা ]]

আলোচক : কবি ও সাংবাদিক