পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে নেই, ব্যাংকিং খাতও নাজুক: অর্থমন্ত্রী
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে নেই। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও নাজুক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে তিনি বলেছেন, পুঁজিবাজারের সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে। আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে।
রোববার সংসদের বৈঠকে মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়ে পৃথক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে বিকেল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা পর্বে একাধিক সদস্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংক মালিক উভয়ের জন্য 'উইন উইন সিচুয়েশন' বজায় রেখে সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করা হবে।' আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সুদের হার এ মুহূর্তে সবার দুশ্চিন্তার জায়গা। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা হবে। এ বছরই এর সুফল দেখা যাবে।'
সরকারি দলের সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটোর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার প্রথম প্রতিফলন পুঁজিবাজারে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি এভাবে সম্পৃক্ত থাকে। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত চাঙ্গা ও শক্তিশালী। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ আমাদের অর্থনীতি দেখে উচ্ছ্বসিত। তারা অন্যান্য দেশকে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেছে।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'এই এগিয়ে যাওয়া থমকে যাবে যদি পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়। পুঁজিবাজার এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই, তাও বলব না। পুঁজিবাজারের যেসব সমস্যা আছে, তা চিহ্নিত করেছি। একে একে সব সমস্যার সমাধান করব।' তিনি বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে যতটা যত্নশীল, পুঁজিবাজার নিয়ে ততটাই যত্নশীল।
পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়ে তিনি নিজেও একাধিক বৈঠক করেছেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, আরও বৈঠক হবে। অন্য আর ১০টি দেশের পুঁজিবাজার যেভাবে চলে, এখানেও সেভাবে চালানোর চেষ্টা করা হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব জায়গায় বিচ্যুতি আছে, তা অবশ্যই দূর করা হবে।
সুদের হার নিয়ে অর্থমন্ত্রী: সরকারি দলের সদস্য ইসরাফিল আলমের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেকের ধারণা, ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থায় আছে। এটা স্বীকার করতে দোষ নেই। প্রতিটি দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি উন্নয়নশীল দেশে সব খাতকে সমভাবে সুন্দর ও সমভাবে পরিচালনা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর মধ্যেও আমাদের ব্যাংকিং খাত খারাপ করছে, তা বলব না। খারাপ করলে তা হলে বিশ্বের পাঁচটি মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি অর্জনের দেশে পরিণত হওয়া যেত না। সবার ওপরে রয়েছে এখন বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আমাদের সমকক্ষ দুটি দেশ। একটি চীন আর অন্যটি হচ্ছে ভারত। এই অর্জন ব্যাংককে বাদ দিয়ে হয় না। ব্যাংক একটি বড় এলাকা। আর্থিক খাত ও ব্যাংক খাতকে বাদ দিয়ে এত বড় অর্জন সম্ভব নয়। তারপরও বলব, সুদের হার অনেক বেশি। এখানে যে পরিমাণ সুদ ধরা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা কিন্তু ব্যাংকগুলো পায় না। কয়েক দিন পরপরই ঋণ পুনঃতফসিল করতে হয়।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ ঋণের সুদ পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বুঝেশুনে শিল্প ও বাণিজ্য রক্ষা করার জন্য যে সিঙ্গেল ডিজিটের কথা বলেছিলেন, তা গ্রহণযোগ্য ছিল। কারণ, সিঙ্গেল ডিজিটের ওপরে হলে যিনি ঋণ নিয়েছেন, তিনি শোধ দিতে পারবেন না। আর যারা দিয়েছেন, তারাও পাবে না। কয়েক দিন পর পুনঃতফসিল করতে হয়। এতে দিনের শেষে দেখা যাবে ৯ শতাংশও পাচ্ছে না।
মুস্তফা কামাল বলেন, শিগগিরই সারাবিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত করে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক সুদহার নির্ধারণ করা হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য তা হবে টার্নিং পয়েন্ট। আর না করতে পারলে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে যাবে। দুর্বল জায়গাগুলো আরও দুর্বল হতে থাকবে।
জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক দেউলিয়া হোক, সরকার তা চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক বাঁচাতে যে পরিমাণ সহযোগিতা করা দরকার, সরকার তা করবে। ফারমার্স ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে বলে যে এর উত্তরসূরি পদ্মা ব্যাংকও ব্যর্থ হবে, তেমন নয়। তারা আশা করছেন, পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। যারা ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন, তারা অবশ্যই সে টাকা ফেরত পাবেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, যেভাবে ঋণের সুদ নির্ধারণ করা হয়, তাতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সরল সুদ আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অতীতে অনেক বিষয়ে অনেক কমিটি হয়েছে, তবে সুরাহা হয়নি। ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাধান নিয়ে কাজ চলছে। ব্যাংক কমিশন গঠনের আর প্রয়োজন হবে না।
শহীদুজ্জামান সরকারের তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, অধিকাংশ ব্যাংক তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মেয়াদি ঋণ খাতে সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কমানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী সুদের হার কমায়, তা নিবিড়ভাবে মনিটর করা হচ্ছে।
অন্যান্য বিষয়: সরকারি দলের সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে। এ প্রবণতা রোধে আইন সংশোধন করা হয়েছে। এ আইন এ বছরের ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা আছে।
মামুনুর রশীদ কিরণের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ বাবদ ৮১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে আসল বাবদ ৬৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা এবং সুদ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা রয়েছে।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ২৮,২০১৯)