বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রম : প্রসঙ্গ ইংরেজী মাধ্যম
ডক্টর মো. মাহমুদুল হাছান
বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আবার কেউবা বলে থাকেন সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তবে কথা যাই হোক না কেন কোনো কিছুর মেরুদন্ড শক্ত হওয়ার অর্থ তার গোটা কাঠামো শক্ত হওয়া । সুতরাং জাতির মেরুদণ্ড শক্ত হলেই বুঝতে হবে সে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো ও টেকসই । আমরা বিশ্বাস করি, যে শিক্ষার উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন । যে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা যত উন্নত সে জাতিও তত উন্নত। শিক্ষা সম্প্রসারণের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হলে দেশের সকল জাতি-গোষ্ঠী তথা সকল নাগরিক উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করতে পারে । শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যক্রমের ধরন ও বাস্তবায়নের ক্রমধারানুযায়ি মূল্যায়নভিত্তিক সঠিক প্রতিফলনের উপর ।
শিক্ষা গবেষকবৃন্দ তাদের গবেষণার ফল স্বরূপ ধাপে ধাপে যে পদক্ষেপগুলো নিয়ে থাকেন তা যদি বাস্তবমুখী ও ব্যবহারিক হয়, তা যে কোন দেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে । বাংলাদেশে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা কিন্তু কম হয়নি, নানা সময়ে বিভিন্ন কমিশন গঠন করে নানাবিধ শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। যার সুফল বা কুফল আমরা ক্ষেত্র বিশেষ দেখতে পেয়েছি। সুফল হলে তো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে আরও উন্নতির পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে । কিন্তু কুফল হলে তার যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সমাজে বা জাতিতে বহুকাল ব্যাপী বিদ্যমান থাকে তা আমরা দেরিতে হলেও বুঝতে পারি । আর এ কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষা কার্যক্রমের বার বার পরিবর্তন ও পরিমার্জন পরিলক্ষিত হয় । ফলে আমরা এগোতে পারি না সামনের দিকে বা উন্নয়নের ধারাকেও দীর্ঘ দিনের জন্য টেকসই করতে পারি না । যাহোক, শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম যতদিন মানসম্মত ও টেকসই না হবে ততদিন আমাদের দেশের উন্নয়নের দীর্ঘসূত্রিতা চলমান থাকবে ।
এবার আলোচনা করা যাক কারিকুলাম বা শিক্ষাকর্যক্রমের উপর। Curriculum শিক্ষা কার্যক্রম আসলে কি বা আমাদের দেশে কি ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে তা জানা আমাদের আবশ্যক । শিক্ষা কার্যক্রম বলতে ইংরেজিতে কারিকুলামকে (Curriculum) কে বুঝি। স্বাভাবিক অর্থে কারিকুলাম বলতে কোন পাঠ্যক্রম, শ্রণি কার্যক্রম বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাঠামোবদ্ধ কোন শিক্ষা বিষয়ক অবস্থাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে কারিকুলাম বলতে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত শিক্ষা পরিকল্পনা, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, শ্রেণিবিন্যাস ও শিক্ষার মানদণ্ড নিরূপণকে বুঝায়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ক্রমউন্নয়নশীল বিধায় তা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এক কথায়, কারিকুলাম বলতে শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স, স্তর ও মানভেদে যে শিক্ষা পরিকল্পনা করে থাকেন তাকেই বুঝায়।
বিভিন্ন শিক্ষাবিদ কারিকুলাম এর সংজ্ঞায় বলেছেন,
‘Curriculum refers to the knowledge and skills, students are expected to learn, which includes the learning standards or learning objectives they are expected to meet; the units and lessons that teachers teach; The assignments and projects given to the students; the book materials, video presentation and readings used in a course; the tests, assignments and other method used to evaluate students’ learning.’
মোদ্দাকথা হলো, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষা সহায়ক সকল প্রকার উপাদান-উপকরণ ব্যাবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী জ্ঞান ও দক্ষতা বিতরণকেই শিক্ষা কার্যক্রম বা কারিকুলাম (Curriculum) বলে ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন, স্তর ও মাধ্যম হিসাবে শিক্ষা কার্যক্রমে ভেদাভেদ থাকতে পারে। আমাদের দেশে নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন, সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা। আবার এসবেরই বিভিন্ন স্তর রয়েছে যেমন, প্রাক প্রথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাস্তর।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন ও স্তর যাই হোক না কেন, এদের শিক্ষার মাধ্যম কিন্তু দুটি; একটি বাংলা ও অন্যটি ইংরেজি। আমার প্রবন্ধের লেখ্য-আলোচ্য বিষয়ও এটি। বাংলাদশের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে লেখা পড়ার বিষয়টি সকল অভিভাবকের মাঝেই এ সম্পর্কে জানার একটি কৌতূহল থেকেই থাকে। আশাকরি আমার এ প্রবন্ধ পাঠের পর সকল সন্দেহের লেশ কেটে যাবে এবং ইংরেজী মাধ্যম সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা লাভ করতে পারবে। প্রথমে আসা যাক অভিভাবকরা কেন তাদের ছেলে-মেয়েরকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে এবং ইংরেজী ভাষা জানা আবশ্যক কেন। এর কারণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে-
১। ইংরেজি ভাষা এখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম।
২। কম্পিউটারের ভাষা ইংরেজি।
৩। আন্তর্জাতিক অংগনে আইন আদালতের ভাষা ইংরেজি ।
৪। সরকারি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পদ ও পদবী আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ইংরেজি।
৫। ব্যবসা-বাণিজ্যে ও আমদানী-রপ্তানীতে ভাব প্রকাশ ও লেনদেনের ভাষা ইংরেজি।
৬। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সকল ডিভাইস ও যন্ত্রাংশের নামও ইংরেজি।
৭। মাতৃভাষার পাশাপাশি বিশ্বের কয়েকটি দেশ ছাড়া সকল দেশে দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি।
৮। Globalization এর যুগে আন্তর্জাতিক ভাবে সম্পর্ক স্থাপনের ভাষা ইংরেজি।
সুতরাং এ কথা অস্বিকার করা যায় না যে, ইংরেজী এখন আপামর দেশ জনতার ভাষা। এ ভাষা জানা যে অতি আবশ্যক, সে কথা আমাদের কাছে স্পষ্ট। আধুনিক বিশ্বে উন্নতির সোপানে উঠতে গেলে ইংরেজি ভাষা জানার বিকল্প নেই, আর ইংরেজিতে পারদর্শী হতে গেলে আমাদের ছেলে মেয়েদের অবশ্যই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করতে হবে, এবং তা হওয়া উচিত ক্যামব্রিজ বা এডেক্সেল কারিকুলামের যে কোন একটিতে। কারন এ কারিকুলাম বিশ্বব্যাপী একযোগে একই ধারায় ও একই শিক্ষাক্রম বা পাঠ্যক্রমে শিক্ষাদান করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে গতানুগতিক ধারার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া-লেখার তেমন কোন সাজানো গুছানো শিক্ষা কার্যক্রম ছিলো না। ততকালীন সময়ে দেশটি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও অনেকেই এটিকে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বিবেচনা করত। আজও সে ধারা আমাদের দেশে অব্যাহত রয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে মুলতঃ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা ও এ মাধ্যমে পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে, ব্রিটিশ শাসনের শক্তিশালি প্রভাব আমাদের এই পাক-ভারত উপমহাদেশে আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভুটান ও শ্রীলংকাসহ অনেক রাষ্ট্রে দ্বিতীয় অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ইংরেজীই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাও উন্নত ভবিশ্যত গড়ার মানসিকতায় ইংরেজি শিক্ষা কার্যক্রমে পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে । এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে দুটি শিক্ষা কার্যক্রম অনুসরন করা হয়ে থাকে। একটি হলো ইংরেজি মাধ্যম জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম ও অন্যটি হলো ইংরেজি মাধ্যম আন্তর্জাতিক শিক্ষা কার্যক্রম। উভয় শিক্ষা কার্যক্রমেই ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান, পরীক্ষা কার্যক্রম ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বিধিমতাবেক জাতীয় পাঠ্য পুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত বইসমুহ পড়ানো হয় এবং পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহন করা হয়।
কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম আন্তর্জাতিক শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পূর্ণ বিদেশী লেখকের লিখিত পুস্তকসমুহ বিধিবদ্ধ পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠদান করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক এ শিক্ষা কার্যক্রমে প্রধান তিনটি ধারা অব্যাহত রয়েছে; একটি হলো পিয়ারসন এডেক্সেল ( Pearson Edexcell), ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন (CIE)| এ দুটি ইংল্যান্ড ev BD †K ভিত্তিক cixÿvi বোর্ড যার মাধ্যমে সারা বিশ্বে একই সাথে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর অন্যটি হলো ইন্টারন্যাশনাল বাকালরিয়েট ( International Baccalaureate) যা আমেরিকা ভিত্তিক বোর্ড এর মাধ্যমে সকল পরীক্ষা পরিচালিত হয়ে থাকে। ইউ কে বা ইউ এস এ ভিত্তিক যে শিক্ষা কার্যক্রমই হোক না কেন সকল কার্যক্রমেই দেশীয় বা জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে অনেকটাই সংগতিহীন। বিদেশী লেখকের লিখিত বইই এ শিক্ষাকার্যক্রমে পড়ানো হয়। ইউ কে বা ইউ এস এ কর্তৃক নির্দেশিত শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে থাকে। পরিক্ষার বিষয় , রুটিন, পাঠ্য তালিকা ও পরীক্ষা্র দিক নির্দেশনাসহ শিক্ষাক্রমের সকল কিছুই উক্ত বোর্ড সমূহ দ্বারা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়। এডেক্সেল ও ক্যামব্রীজ উভয়টি এদেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে।
তাহলে আমরা প্রথমতঃ জেনে নিতে পারি পিয়ারসন এডেক্সেল শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যক্রম কি এবং এটি কিভাবে বাস্তবায়িত হয়।
এডেক্সেল প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ড এর দু’টি প্রধান প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান দু’টি হলো বি টি ই সি বা (BTEC - Business Technology Education Council) ও ইউ এল ই এ সি ( ULEAC - University of London Examination and Assessment Council). ২০০৩ সালে এডেক্সেল ফাউন্ডেশন নামক একটি দাতব্য সংস্থা পিয়ারসনের সাথে যুক্ত হয় এবং লন্ডন কোয়ালিফিকেশন লিঃ নামে একটি পৃথক কোম্পানি গঠন করে যার ৭৫% শেয়ার ছিল পিয়ারসনের এবং ২৫% শেয়ার ছিল এডেক্সেলের। ২০০৪ সালে সম্মিলিত এক সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটি এডেক্সেল লিমিটেড হিসেবে পূনরায় নামকরণ করা হয় । তখন থেকে এটি এডেক্সেল বা পিয়ারসন এডেক্সেল নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৫ সালে এডেক্সেল একটি বড় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর হেড কোয়ার্টার লন্ডন এবং চেয়ারম্যান হলেন ডেভিড মেলভিল সি বি ই। এটি এখন বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর একটি আন্তর্জাতিক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বোর্ড। বিশ্বের প্রায় ৭২ টি দেশে এডেক্সেলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এদের পরীক্ষা গুলোকে কোয়ালিফিকেশনস বলা হয়। (ক্রমশ)
লেখক: প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এপ্রিল ২৯,২০১৯)