মাহে রমজানের মর্যাদা ও আমল
আবুল বাশার
রোজা ফারসি শব্দ। এর আরবি প্রতিশব্দ 'সাওম'। 'সাওম' এর বহুবচন 'সিয়াম'। ইংরেজিতে বলা হয় 'fasting'। সাওম শব্দের অর্থ হল- আত্ম সংযম, কঠোর সাধনা, অবিরাম চেষ্টা, বিরত থাকা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায়- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকার নাম- রোজা।
রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। আত্মশুদ্ধির মাস। প্রশিক্ষণের মাস। সংযম সাধনার মাস। কুরআন নাযিলের মাস। অফুরন্ত সওয়াব অর্জনের মাস। তাকওয়াভিত্তিক জীবন গঠনের মাস। মূলত রমজানের এত মর্যাদা কুরআন নাযিলের কারণে।
কুরআন মাজীদ যখন কোন বিষয়ের পরিচয় তুলে ধরে তখন তার শব্দচয়ন ও প্রকাশভঙ্গীতেই বোঝা যায় তার মর্যাদা ও গুরুত্ব কতটুকু। আমরা বিশেষ কোন ব্যক্তিকে পরিচয় দিতে গিয়ে বলি, "এ তো সেই ব্যক্তি যার সাথে অমুক যায়গায় দেখা হয়েছিল। খুব ভাল মানুষ। চমৎকার করে কথা বলে। তার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে। সহজেই যে কোন মানুষকে আপন করে নিতে পারে।"এভাবে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিলে তার সম্পর্কে সবাই সুধারণাই পোষণ করবে।
ঠিক তেমনি কুরআন মাজীদ তার নিজের পরিচয় তুলে ধরেছে সূরা বাকারার শুরুতে এভাবে- "এটা তো সেই কিতাব, যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক...।
একইভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে- "রমজান মাস হল ঐ মাস যে মাসে নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন, যা সমগ্র মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক আর হেদায়াতের জন্য উপদেশ সমৃদ্ধ এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এ মাসের সাক্ষাত পায় সে যেন রোজা রাখে।" (সূরা বাকারা-১৮৫)।
এখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। যেমন-
১. কুরআন মাজীদ প্রচলিত কোন ধর্মগ্রন্থের নাম নয় যে তা নির্দিষ্ট কিছু লোকের জন্য রচিত। বরং তা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান যা সমগ্র মানব জাতির জন্য পথ প্রদর্শক। ধর্ম-বর্ণ, বংশ-গোত্র, সাদা-কালো, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই তা ধরতে পারে, পড়তে পারে, গবেষণা করতে পারে। যার ইচ্ছা এটাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারে আবার নাও পারে। যারা এটাকে সত্য বলে মেনে নেবে তারা সুপথ প্রাপ্ত হবে।
২. কুরআন মাজীদ মানব রচিত কোন কিতাব নয়। বরং তা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লহ্র পক্ষ থেকে প্রেরিত।
৩. মানুষের হেদায়াতের জন্য যত উপদেশের প্রয়োজন তা সব এতে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৪. সত্য - মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য কুরআন হল মানদণ্ড।
কুরআন মাজীদ নাযিলের কারণে রমজান মাসের মর্যাদা বেড়ে গেছে।
শুধু রমজান মাস নয় রমজানের রাতের মর্যাদাও বেড়ে গেছে এই কুরআনের কারণে।
মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- 'নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি বরকতময় রাতে।'(সূরা দুখান-৩)। বরকতময় রাতের পরিচয় দেয়া হয়েছে অন্য আয়াতের মাধ্যমে। কুরআনের ভাষায়- 'নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাত্রিতে।'(সূরা কদর-১)। আর একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, কদর রাত রমজান মাসে অবস্থিত।
কদর রাতের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'কদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।'(সূরা কদর- ৩)।
কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম হওয়ার কারণ হল কুরআন নাযিলের পূর্বে হাজার হাজার মাস অতিক্রান্ত হয়েছে অথচ কুরআন নাযিলের মত গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা ঘটেনি।
আনাস বিন মালিক (রা) বর্ণনা করেন- রমজান মাস শুরু হলে রাসূল (সা) বললেন- তোমাদের নিকট এ (রমজান) মাস সমুপস্থিত। এতে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হল সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল। কেবল বঞ্চিত ব্যক্তিরাই তা থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাযাহ)।
রমজান মাসের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন-যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজা সমুহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজা সমুহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম)
অন্য হাদীসে এসেছে- রমজান মাস আসলে আসমানের (রহমতের) দরজা সমুহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমুহ বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা হয়। (বুখারী)।
আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন- শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনদেরকে রমজান মাসের প্রথম রাতেই শৃংখলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর একটি দরজাও আর খোলা হয় না। খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো এবং এর একটি দরজাও আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন - 'হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে মাযাহ)।
আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন - রাসূল (সা) বলেছেন, যে 'ঈমানের সাথে ও আত্মসমালোচনা সহকারে রোজা রাখে তার পূর্বের গুনাহরাশী মাফ করা হয়। আর যারা ঈমানের সাথে ও আত্মসমালোচনা সহকারে কদরের রাত্রিতে (নামাযে) দাঁড়ায় তার পূর্বের গুনাহসমুহ মাফ করা হয়।'(বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাযাহ)।
রমজানের এত মর্যাদা মূলত কুরআনের কারণে। সুতরাং কেউ যদি রমজানের মর্যাদা দিতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম তাকে কুরআনের মর্যাদা দিতে হবে, কুরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কুরআনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অর্থ এই নয় যে তা চুমু খেয়ে গেলাফে মুড়িয়ে তাকে উঠিয়ে রাখা কিংবা তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখা। বরং কুরআনের মর্যাদা দিতে হবে চিঠি বা সার্কুলারকে মর্যাদা দেয়ার মত। চিঠি-সার্কুলার আসলে আমরা যেমন তাতে উল্লিখিত উপদেশ ও নির্দেশাবলী পালন করার মাধ্যমে তার মর্যাদা দিয়ে থাকি ঠিক তেমনি কুরআন মাজীদ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার। তাই এর মর্যাদা দিতে হবে একে যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিশ্চয় এ (কুরআন) তোমার নিজের ও তোমার সম্প্রদায়/অনুসারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ। আর অচিরেই এ সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।' (সূরা যুখরূফ-৪৪)।
যারা কুরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখে তারাই এর যথাযথ সম্মান করে। কুরআনের প্রতি বিশ্বাসীদের পরিচয় কুরআনেই দেয়া হয়েছ এভাবে – প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার তারাই আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলে যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় আর তারা তাদের রবের উপর ভরসা করতে শুরু করে। (সূরা আনফাল-২)।
আল্লহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার অর্থ হল নাফরমানীর কারণে আল্লাহর আজাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া, যাতে অন্তর কেঁপে ওঠে। আর মানুষের সামনে কুরআন তিলাওয়াত করার অর্থ হল কুরআনের সরল অনুবাদ ব্যাখ্যাসহকারে পেশ করা যাতে আল্লাহর হুকুম-আহকামের কথা শুনে তাদের ঈমান বেড়ে যায়। আর তার নিয়ামতের কথা শুনে আল্লাহর প্রতি আস্থা বেড়ে যায়।
রমজান মাস নিকটবর্তী হলে আমাদের উচিত হল রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রাসূল (সা) সাবান মাস আসলে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে অধিকহারে রোজা থাকতেন। আমরাও সাবান মাসে রোজা থেকে রোজার প্রস্তুতি নিতে পারি।
রমজান মাসকে কাজে লাগানোর জন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা করতে পারি। যেমন-
১. যারা কুরআন পড়তে পারি না তারা কুরআন পড়া শিখতে পারি।
২. আমরা যারা শুধু পড়তে পারি কিন্তু অর্থ জানি না তারা অর্থ জানার চেষ্টা করতে পারি। গবেষণায় দেখা গেছে কুরআনের মাত্র দুইশত (বাছাইকৃত) শব্দের অর্থ জানতে পারলে কুরআনের তিন ভাগের দুই ভাগ শব্দের অর্থ জানা হয়ে যায়। (সূত্র - কুরআনের ২০০ শব্দের অভিধান, কুরআন রিসার্স ফাউন্ডেশন)। নিয়মিত অর্থসহ কুরআন পড়া অব্যাহত রাখলে বাকি শব্দগুলোর অর্থও জানা হয়ে যাবে।
৩. জীবন ঘনিষ্ঠ ৩০টি বিষয় নির্ধারণ করে প্রতিটি বিষয়ের উপর ২/৩টি আয়াত ও ১/২টি হাদীস বাছাই করে নিয়ে প্রতিদিন একটি করে বিষয় অধ্যয়ন করতে পারি।
৪. যত বেশি সম্ভব রোজাদারকে ইফতার করাতে পারি, সাহারীও খাওয়াতে পারি।
৫. বেশি বেশি দান-সদকা করতে পারি।
৬. নিজরা তাহাজ্জুদ নামাজে অভ্যস্ত হতে পারি।
৭. পরিকল্পিতভাবে কিছু লোককে যাকাত দানে উৎসাহিত করতে পারি।
৮. পরিকল্পিতভাবে কিছু নিয়মিত মুসল্লি তৈরি করতে পারি।
৯. এক রমজানে অন্ততপক্ষে একজন অভাবীকে বড় অনুদান দিয়ে সাবলম্বী হতে সহযোগিতা করতে পারি।
১০. এক বা একাধিক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে সহযোগিতা করতে পারি।
১১. পরিবারের সদস্যদেরকে সব ধরণের ভাল কাজে উৎসাহিত করতে পারি।
১২. ভোগ নয় ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে জীবন গঠন করতে পারি।
১৩. হিংসা ও বিভেদ ভুলে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারি।
রমজান সম্পর্কে রাসূল (সা) এর একটি সতর্ক বার্তা দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। নবী (সা) বলেন- 'যে ব্যক্তি (রোজা থেকে) অনর্থক কথা ও কাজ পরিত্যাগ করেনা তার পানাহার থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।' (বুখারী)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রমজানের হক আদায় করে রোজা থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: গবেষক ও আলেমে দ্বীন
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ১০,২০১৯)