এ.কে.এম মহিউদ্দীন

আজ ১১ রমজান। শুরু হলো মাগফেরাতের দশক। মাগফেরাত অর্থ মার্জনা। পাপাসিক্ত মানব জীবনের পরম কাঙ্ক্ষিত বিষয় ক্ষমা বা মার্জনা প্রাপ্তি। আর এই দারুণ খোশখবর নিয়ে প্রতিবছর আমাদের সামনে সমাগত হয় পবিত্র রমজান। সাথে তার রহমত ও নাজাতের অফুরন্ত ভাণ্ডার। মুমিন জীবনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য বছরের শ্রেষ্ঠতম সময় এই মাসটুকু। মুমিন জীবন কীভাবে গঠিত হবে তার একটি অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সম্পর্কে কোরআনে বলা হচ্ছে,‘তোমাদের জন্য রাসূলের [সা.] চরিত্রে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ [সুরা আহযাব:২১]

আমরা এখানে রমজানে রাসূল [সা.] যা যা করেছেন, তা সংক্ষেপে আলোচনা করছি। রাসূল মোহাম্মদ [সা.] তিনি এ মাসে যা করেছেন তাই করা আমাদের উচিত। তার ফলে উত্তম চরিত্রের আদর্শ আমাদের রোজাকে আলোকিত করবে। কেননা, তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি বলেছেন, ‘আমাকে উন্নত চারিত্রিকগুণের পরিপূর্ণতার জন্য পাঠানো হয়েছে।’

তিনি রমজানে বেশি বেশি ও বহুমুখী এবাদত করতেন। রমজানে জিবরিল [আ.] রাসূল [সা.] কে কোরআন শিক্ষা দিতেন। এরপর তিনি খুব বেশি দান করতেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস [রা.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল [সা.] লোকদের মধ্যে সর্বাধিক দাতা ছিলেন। কিন্তু রমজানে যখন জিবরিল [আ.] তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং কোরআন শিক্ষা দেন, তখন তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন। জিবরিল [আ.] রমজানে প্রত্যেক রাতে তাঁকে কোরআন শিক্ষা দিতেন। তার সাথে সাক্ষাতের পর রাসূল [সা.] প্রবাহমান বাতাসের মতো দানশীল হয়ে উঠতেন।’

এই মাসে তিনি সর্বাধিক কোরআন অধ্যয়ন করতেন। স্বয়ং জিবরিল [আ.] তাঁকে প্রত্যেক রাতে কোরআন শিক্ষা দিতেন। এছাড়াও তিনি তারাবি ও তাহাজ্জুদে বেশি পরিমাণ আয়াত ও সুরা পাঠ করতেন। লোকদেরকেও কোরআনের সূরা ও বিভিন্ন অংশ শিক্ষা দিতেন। লোকদেরকে দিয়ে ওহি লেখানোর সময়ও তাঁকে কোরআন পড়তে হতো। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন নামাজ ও নফল নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। এমনিতেও কোরআন তেলাওয়াত করতেন।

তিনি রমজানে এমন কিছু অতিরিক্ত এবাদত করতেন যা অন্য কোন মাসে করতেন না। তিনি কখনও বিনা বিরতিতে এবং ইফতার ও সেহরি ছাড়াই রোজা রাখতেন। এটাকে আরবিতে সাওমে বিছাল বলে। যার বাংলা বিরতিহীন রোজা। দিন ও রাতে এবাদতের জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করার উদ্দেশ্যেই তিনি অবিরাম রোজা রাখতেন। তবে তিনি এই প্রকারের রোজা রাখতে সাহাবি ও তার উম্মাতগণকে নিষেধ করেছেন। সাহাবিদের এসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি তোমাদের মত নই। আমি আমার প্রভুর কাছে রাত যাপন করি। তিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান। [বুখারি, মুসলিম ও মোয়াত্তায়ে মালেক]

রাসূল [সা.] রমজানের রাতকে নামাজসহ অন্যান্য এবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করতেন। তিনি ছিলেন সর্বাধিক জিকির ও এবাদতকারী। রাতে তিনি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা, দয়া, রহমত ও বরকত কামনা করতেন, মুনাজাত করতেন, কান্নাকাটি করতেন, কল্যাণ হেদায়াত ও বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন। নামাজে সুদীর্ঘ কেরাত পাঠ করতেন এবং রুকু সেজদাহ অত্যধিক দীর্ঘ করতেন। নির্ধারিত এবাদতকে পর্যাপ্ত মনে করতেন না। তাই বেশি বেশি এবাদতের এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়, এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত করণীয়। তোমার রব তোমাকে সম্মানিত মর্যাদায় পৌঁছাতে পারেন। ’ তাহাজ্জুদ ছাড়াও তিনি রমজানে তারাবির নামাজ অতিরিক্ত পড়তেন। এভাবে, বলতে গেলে গোটা রাতেই নামাজে কেটে যেত। সাথে অন্যান্য এবাদত তো আছেই। দিনে তার ব্যস্ততা ছিল অন্য রকম। তিনি দাওয়াত ও তাবলিগ, ওয়াজ নসিহত, শিক্ষাদান ও ফতোয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। লোকদেরকে সৎউপদেশ দেয়া এবং তাদের পরিশুদ্ধির জন্য সময় ব্যয় করতেন। রাসূল [সা.] শুকনা পাকা খেজুর কিংবা গাছপাকা তাজা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করতেন। যেহেতু ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয় তাই তিনি দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক কল্যাণের জন্য ইফতারের সময় দোয়া করতেন। রমজানে দূরবর্তী স্থানে সফর করলে তিনি রোজা ভেঙে ফেলতেন। কেননা, মুসাফিরের জন্য রোজা ভাঙা জায়েজ আছে। তিনি নিজে দুই রমজানে রোজা ভেঙেছেন। রাসূল [সা.] সোবহে সাদিকের পর ফরজ গোসল করে রোজা রাখতেন। অবশ্য সোবহে সাদিকের আগেই তিনি সেহরি খেয়ে নিতেন। সোবহে সাদিকের পর খানা নিষেধ, ফরজ গোসল নিষেধ নয়। তিনি রমজানে রোজা অবস্থায় কোন কোন স্ত্রীকে চুমু খেতেন। তিনি বলেছেন, ভুলে কেউ খেলে বা পান করলে রোজা ভাঙে না। কেননা, খোদা তাকে খাওয়ান ও পান করান। রাসূল [সা.] রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করেছেন। এছাড়াও হাদিসে আরও বিভিন্ন কল্যাণকর কাজের কথা বর্ণিত আছে যা তিনি রমজান মাসে করতেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে তাবেঈগণ রমজানসহ সকল কাজে তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। তাই আমাদেরও উচিত রমজানে তাঁকে অনুসরণ করা।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ১৭,২০১৫)