যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সম্পর্ক: যুদ্ধ নাকি হুঙ্কার?
মফিজুল ইসলাম
দীর্ঘআলোচনার পর ২০১৫ সালে সংঘটিত ইরান এবং জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানির মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি থেকে গত বছর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প বেরিয়ে যান। এর ঠিক এক বছর পর ইরানও এই চুক্তি থেকে আংশিকভাবে বেরিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর স্থগিত করা সকল অবরোধ আবার চালু করেছে এবং নতুন করে অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে । এর উদ্দেশ্য হল, ইরান যাতে তেল রপ্তানি করতে না পারে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে যায়।
গত সপ্তাহে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতের মোট চারটি জাহাজে এবং সৌদি আরবের দুটি তেল স্থাপনায় রহস্যজনক "অন্তর্ঘাতি আক্রমণের" ঘটনা ঘটে। এর আগে মার্কিন নৌবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছিল, ইরান পারস্য উপসাগরের তেল ট্যাঙ্কারগুলো আক্রমণ করতে পারে । তার ঠিক দুই দিন পরেই এই আক্রমণ হয়েছে । সৌদি বাদশাহ এই হামলার জন্য ৩০শে মে মক্কায় এক জরুরী বৈঠকে বসার জন্য আরব লীগ ও উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট জিসিসি সদস্যদের কাছে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। আর এই আক্রমণ নিয়ে যেভাবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রচারনা চালাচ্ছে, তাতে এটা ইরান আক্রমণের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা বলেই মনে হয়। ঠিক যেমন ইরাকে আগ্রাসনের আগে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে রাসায়নিক অস্ত্রের মিথ্যা রিপোর্ট উপস্থাপন করে সারা বিশ্বের সাথে প্রতারণা করা হয়েছিল ।
এমনিতেই ইরানকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে আছে ইসরাইল । আর তাদের সাথে আছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। কিন্তু আঘাত করার জন্য যে অজুহাত দরকার তা পাওয়ার জন্য চলছিল ইরানের উপর ব্যাপক গুপ্তচরবৃত্তি। এই উদ্দেশ্যে ইসরাইলের সফটওয়্যার কোম্পানি তেরি করে হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাকিং।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে বিমানবাহী রনতরী, ক্ষেপনাস্ত্র বাহক অ্যাটাকিং জাহাজ ও এফ-৩৫ বিমান বহর মোতায়েন করার পর উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে ।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও রাশিয়া সফরে বলেন, "ইরানের সাথে যুদ্ধ চায়না যুক্তরাষ্ট্র" । যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান যেন “স্বাভাবিক দেশের” মতো আচরণ করে । তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আক্রান্ত হলে তারা “সমুচিত জবাব” দেবে বলেও জানিয়ে দেন । এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ও বলেছেন, ইরানের সাথে যুদ্ধের পক্ষে নন।-খবরঃ বিবিসি।
অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ হবে না ইরানের । তবে তিনি বলেছেন, ডোনাল্ট ট্রাম্প ইরানের সাথে যে পরমাণু চুক্তি বাতিল করেছেন, সেটার বদলে ভিন্ন কোন চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আপস করবে না ইরান । তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, তারাও যুদ্ধ চায় না । সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদিল আল জুবেইর রোববার রিয়াদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সৌদি আরব এ অঞ্চলে কোন যুদ্ধ চায় না ।“
তবে কেউ যুদ্ধ চায় না বললেও উভয়ের স্বার্থের ব্যপারে আপস করবে না বলেছেন । কিন্তু উত্তাপ যেভাবে বাড়ছে তাতে কোন পক্ষ নতি স্বীকার না করলে কি হবে বলা মুশকিল । বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের “নাটের গুরু” ইসরাইল কি চায় সেটাও গুরুত্বপূর্ণ । কারণ, এ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বন্ধু রাষ্ট্র হল ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইসরাইলের স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারেন।
মধ্যপ্রাচ্যের ইরান বিরোধী ইসরাইল, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত জোট চায় ইরানকে চাপে রেখে এ অঞ্চলে তার প্রভাব দমিয়ে রাখতে । বিশেষ করে বিশ্বের একমাত্র ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল তার স্বার্থ রক্ষার জন্য যেকোন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে । আর তা কার্যকর করার জন্য আছে যুক্তরাষ্ট্র । আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট “আমেরিকা ফার্স্ট “ অর্থাৎ আমেরিকার স্বার্থ সবার আগে -এই নীতিতে বিশ্বাসী ।
সর্বশেষ রোববার এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, “ইরান যদি যুদ্ধ চায়, তাহলে সেটি হবে ইরানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ।“ তিনি ইরানকে সতর্ক করে বলেন, তারা যেন আর কখনও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি না দেয়। অন্যদিকে ইরানের ক্ষমতাধর একজন ধর্মীয় নেতা ইউসেফ তাবাতাবাই-নেজাদকে উদ্ধৃত করে আধা সরকারি ইরানি সংবাদ সংস্থা ইসনা জানিয়েছিল, “একটি ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতেই যুক্তরাস্ট্রের যুদ্ধ জাহাজের বহর ধ্বংস হয়ে যাবে।” এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে । এখন দেখা যাক , মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান তাদের উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করতে কি পদক্ষেপ নেয়।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ মে ২৬,২০১৯)