ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-এক
সন্ধ্যা নামায় রাখি
রোকেয়া আশা
একটা শিং মাছের কাঁটার জন্য পরিবারটার বেহাল অবস্থা।
ঘটনাটা শুরু থেকে গুছিয়ে বলা দরকার। নাজিরের বয়স যখন চার বছর তখনকার কথা ; নাজিরের আব্বা বুধবার সন্ধ্যায় অনেক বাজারসদাই করে ফিরলেন। পানশাইল থেকে মির্জাপুর কিছুটা দূরে হলেও, হাটবারের দিন মির্জাপুর থেকেই নাজিরের আব্বা বাজার করেন। তখন এই এলাকায় কোন বাড়িতেই ফ্রিজ ছিলো না। ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো, কিন্তু বাসাবাড়িতে সিলিং ফ্যান আর হলুদ আলোর লাইট ছাড়া আর কোন কিছুতেই ইলেক্ট্রিসিটি কাজে লাগতো না। নাজিরের আব্বা বাজার করে বড় বড় ছয়টা শিং মাছ নিয়ে এসেছিলেন। জিয়লমাছ। হাড়িতে পানি দিয়ে জিইয়ে রাখা যাবে ; মাছ পচনশীল। দ্রুত নষ্ট হয়। জিয়লমাছের নষ্ট হওয়ার ভয় নাই।
সন্ধ্যার মুখে কুপিবাতির আলোয় নাজিরের আম্মা এই শিংমাছ কাটতে বসেন।
ভদ্রমহিলা ছয়টা মাছের মধ্যে পাঁচটা মাছ হাড়িতে পানি দিয়ে জিইয়ে রেখে বাকি মাছটা কাটার জন্য ছাই আর বটি নিয়ে বসার সময় তার ছেলেমেয়ে দুইজন সাথে ছিলো। নাজির আর তার বড় বোন আফসানা। আফসানার বয়স এগারো, ক্লাস ফাইভে পড়ে।
ওরা দুই ভাইবোন ছাড়াও মাছ গুলো কাটার সময় আরো তিন দর্শক ছিলো। একটা সাদা, আর দুইটা সাদা কমলা মেশানো রঙের বিড়াল।
নাজিরের মা বাড়ির আশেপাশের জন্তু জানোয়ারদেরকেও উচ্ছিষ্ট খাবার খেতে দিতেন। যার ফলাফল, মহিলার এই অনুরাগী সম্প্রদায়।
শিং মাছ কাটার প্রক্রিয়া একটু গোলমেলে। ছাই দিয়ে মাছটা চেপে ধরে খুব কায়দা করে বটিতে পোচ দিতে হয়। নাজিরের মা কায়দা করে ছাই দিয়ে মাছটা চেপে ধরতেই মাছটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
নাজির আর আফসানার চিৎকার শুনে ওদের আব্বা দৌড়ে এসে দেখে মহিলার বাম হাতের তালু থেকে বড় মাছটা ঝুলছে। আস্ত কাঁটাটাই মহিলার হাতে বিঁধে গেছে।
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে ; তবে বিশেষ করে বিবাহিত মহিলার চিকিৎসা নিয়ে যে মাথা ঘামাতে নেই এটা মোটামুটি সর্বজনীন।
নাজিরের আব্বা নাজিরের আম্মার ওপর খুবই বিরক্ত হলেন। সামান্য একটা মাছ কাটতে গিয়ে এরকম লংকাকাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলা সংসারী মেয়েমানুষের লক্ষন না। বিয়ের বারো বছরেও মেয়েলোকটা কিচ্ছু শিখতে পারেনি বলে নাজিরের আব্বা যথেষ্ট বিরক্তও হলেন।
রাতের বেলা নাজিরের আম্মা ফুলে যাওয়া হাত নিয়েই স্বামী সন্তানদের ভাত তরকারি বেড়ে খাওয়ালেন। নতুন আলু আর টমেটো দিয়ে শিং মাছের ঝোল। নাজিরের আব্বার খুব পছন্দের তরকারি। বাজারে নতুন আলু উঠলেই তিনি শিংমাছ নিয়ে আসেন এই তরকারি করার জন্য।
যদিও মহিলা নিজে এক লোকমা ভাতও মুখে তুলতে পারেন নি। মুখ একদম তেতো হয়েছিলো।
নাজিরের আব্বার অতকিছু খেয়াল করার সময় হয়নি। তিনি যথারীতি মাঝরাতে স্ত্রীকে বিছানায় জড়িয়ে ধরলেন ; মনের টানে না। শরীরের টানে। এমনকি উত্তপ্ত শরীরটা যে তখন তীব্র জ্বরে উত্তপ্ত ছিলো সেদিকেও তিনি মনোযোগ দেওয়ার সময় পান নি। আসলেই যে শিং মাছের কাঁটাটা একটা ঝামেলা করেছে সেটা তিনি বুঝতে পারেন পরদিন সকালে। যখন তিনি বিছানায় একটা মৃতদেহ আবিষ্কার করেন তখন। স্ত্রীর মৃতদেহ দেখে ভদ্রলোক তিনটা কারণে ভয়াবহ বিরক্ত হলেন।
প্রথম কারণ হচ্ছে, সামান্য শিংমাছের কাঁটা ফুটে মরে যাওয়াটা কোন কাজের কথা না।
দ্বিতীয় কারণ, দুইটা ছেলেমেয়ে সংসার বউ ছাড়া চালানো খুব ঝামেলার। মহিলা মরে গিয়ে পুরো ঝামেলা নাজিরের আব্বার ওপর ফেলে গেছেন।
তৃতীয় কারণটা একটু লজ্জাজনক। এই কারণ ব্যাখ্যা করার আগে স্ত্রীর মৃতদেহ দেখে নাজিরের আব্বার কর্মকাণ্ডগুলোর বর্ণনা দেওয়া দরকার। তিনি প্রথমেই স্ত্রীর শরীরটা ভালো করে শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে ফরজ গোসলটা করেন। রাতের বেলায় করা কাজের পর নাজিরের মা ফরজ গোসল না করেই নাপাক অবস্থায় মরে যাওয়া তার বিরক্তির তিন নাম্বার কারণ। গোসল করার পরে যখন নিজের লুংগীটা নিজে নিজে ধুয়ে মেলতে হলো, তখন তিনি স্ত্রীর মৃত্যুতে আবারও বিরক্ত হলেন।
গল্পে শিং মাছের ভূমিকা এতটুকুই। এরপরের অংশে নাটকীয়তা কম না বেশি সেটা আলাদা বিতর্ক।
নাজিরের মায়ের চল্লিশার দিন নাজিরের আব্বা আফসানাকে আফসানার মামার সাথে পাঠিয়ে দেন, আর তার দুইদিন পরে আরেকটা বিয়ে করেন। (ক্রমশ)
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুন ০২,২০১৯)