বাংলাদেশ আর ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ নয়
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভক্ত ও সমর্থকদের চেচামেচি, হৈচৈ, শোরগোল আর ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ট্রেন্টব্রিজ স্টেডিয়াম ও তার আশপাশের আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছে বার বার। এমনকি অস্ট্রেলিয়া ৩৮১ রানের হিমালয় সমান স্কোর গড়ার পরও ট্রেন্টব্রিজে বাংলাদেশ ভক্তরা চুপসে যাননি। তারা মনোবল হারাননি।
নটিংহ্যামের এ স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার ছয়েক বাংলাদেশি দর্শক, ভক্ত ও সমর্থকরা ঠিকই আশায় উন্মুখ হয়েছিলেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনি প্রিয় দলকে অনুপ্রাণিত করতে, উজ্জিবীত করতে উদ্দীপ্ত স্লোগানে মাঠ গরম করে রেখেছেন।
কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজের ছয় হাজার বাংলাদেশি ভক্ত আর দেশে টিভি সেটের সামনে ‘চাতক পাখির’ মত বসে থাকা কোটি বাঙালির আশাপূরণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত অজিদের সঙ্গে আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি টাইগাররা, হেরেছে ৪৮ রানে।
শেষ পর্যন্ত ব্যবধানটা প্রায় পঞ্চাশ রানের কাছাকাছি হলেও ৪০ ওভার শেষেও দুদল ছিল খুব কাছাকাছি। তখন মোটে ৫ রানের ফারাক ছিল। কিন্তু সবচেয়ে আফসোসের কথা হলো তারও আগে ২৫ ও ৩০ ওভারে দু'দলের রান তোলার হিসেবে এগিয়ে ছিল মাশরাফির দল।
ইনিংসের মাঝামাঝি বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১৪৬/৩। একই সময় অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ১৩৯/১। পরে ৩০ ওভার শেষেও বাংলাদেশ (১৭৭/৪) অষ্ট্রেলিয়ার (১৬৮/১) চেয়ে ৯ রানে এগিয়ে ছিল ।
ভক্ত-সমর্থকরা অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু আসল পার্থক্যটা ফুটে উঠলো দুটি জায়গায়। অজিরা পেশাদার। আবেগ-উচ্ছ্বাস নয়, তারা ক্রিকেট খেলে মাথা খাটিয়ে বুদ্ধি দিয়ে। ফিঞ্চের দল আগেই জেনে গেছে, দেখেছে বাংলাদেশের কিন্তু ৩২০ রানের আশপাশে করার সামর্থ আছে।
এবারের আসরে দুই দুইবার তারা তা করেও দেখিয়েছে। কাজেই প্রথমে ব্যাট করে এমন এক টার্গেট সেট করতে হবে, যা মাশরাফি বাহিনীর জন্য কঠিন হবে। আর তাই তারা একদম টার্গেট সেট করে লক্ষ্য-পরিকল্পনা আর কৌশল এঁটে বাংলাদেশের বোলিং শক্তিসামর্থ্য এবং বোলারদের একেকজনের বোলিং সামর্থ্য বুঝে অনেক হিসেবনিকেশ করে ব্যাট করেছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অতি দূর্বল ফিল্ডিং, ক্যাচ ও রানআউট করার ধরার সুযোগ কাজে লাগাতে না পারা ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়েছে।
শুরুতে মাশরাফি-মোস্তাফিজের মাপা বোলিং দেখেশুনে খেলে প্রথম ওভারগুলো পার করেছেন। তারপর মূল স্পিন ট্রাম্পকার্ড বাঁহাতি সাকিবের ওপর একটু বেশি চড়াও হয়ে তাকে নিবৃত্ত করেছেন ডেভিড ওয়ার্নার। সবচেয়ে বড় কথা, ইনিংসের বড় সময় ওভার পিছু ৬ রানের নিচে থেকেও উইকেট হারায়নি অজিরা। হাতে উইকেট রেখে খেলেছে শুরু থেকে।
তাই তো ৩০ ওভারের সময়ও ফিঞ্চবাহিনী মাত্র এক উইকেট হারিয়েছিল। বেশিসময় একটি মাত্র উইকেট থাকার মানেই বড় পার্টনারশিপ গড়ে ওঠা,উঠেছেও। ফিঞ্চ আর ওয়ার্নার প্রথম উইকেটে ২০.৫ ওভারে ১২১ আর দ্বিতীয় উইকেটে ওয়ার্নার উসমান খাজার ১৯২ রানের একজোড়া বিশাল জুটিই অসিদের নিয়ে গেছে ৩৮০‘র ঘরে।
হাতে উইকেট বেশি থাকায় শেষ ১০-১২ ওভার অনেক বেশি হাত খুলে ইচ্ছেমত মেরে রান গতি বাড়ানোর সুযোগ ছিল। আর তা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে অসিরা। শেষ ১০ ওভারে ফিঞ্চ বাহিনী তুলেছে ১৩১। সেখানেই আসলে পার্থক্য গড়ে উঠেছে।
তারপরও যা হয়েছে, সেটাই কি খুব কম? যে দলটির সর্বোচ্চ রান ছিল ৩৩০। যারা আগে কখনও ৩২২ রানের বেশী টার্গেট স্পর্শ করেনি, সেই দলের সামনে ৩৮২ রানের টার্গেট যে অনেক বড়। হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার মতই। তাও আফগানিস্তান কিংবা আয়ারল্যান্ড নয়, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।
যে দলের দুই বোলার মিচেল স্টার্ক আর কামিন্স হলেন এবারের বিশ্বকাপের সফলতম বোলারদের অন্যতম। উইকেট শিকারে সেরা পাঁচে যাদের অবস্থান। সেই দলের বিপক্ষে নিজেদের ছাপিয়ে যাওয়া। বিশ্বকাপ তথা ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজেদের সবচেয়ে বেশি ৩৩৩ রান করে ৪৮ রানে হারা- খুব কি খারাপ?
অতি বড় বোদ্ধা, পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। পাড়ার গলির ধারে ছেলেটিও বলে দেবে- আরে বাংলাদেশ তো দারুণ খেলেছে। কেউ কোন দিন যা পারেনি, মাশরাফির দলের সামনে ছিল সেই অধরা টার্গেট।
পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানাচ্ছে বিশ্বকাপের ৪৪ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে আগে কখনো কোন দল ৩৮১ রান টপকে জয় পায়নি। ইতিহাস আর পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বাংলাদেশ কেন? বিশ্বকাপের ইতিহাসে কেউ কখনো ৩৮২ রান করে জেতেনি।
বিশ্বকাপে রান তাড়া করে জেতার সর্বোচ্চ রেকর্ড বিস্ময়করভাবে কোন বড় দলের নয়। সবচেয়ে বড় রান তাড়া করে জেতার রেকর্ডটি আয়ারল্যান্ডের। সেটা ২০১১ সালে ভারত, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কায় হওয়া বিশ্বকাপে। সে বছর ২ মার্চ ব্যাঙ্গালুরুতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩২৯ রান করে জিতেছিল আইরিশরা।
দ্বিতীয় সর্বাধিক রান তাড়ার রেকর্ডটি বাংলাদেশের। একটি এই সেদিন টনটনে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আর তার আগেরটি ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। দুই ম্যাচেই দ্বিতীয় ইনিংসে টাইগারদের সংগ্রহ ছিল ৩২২।
এ তো গেল বিশ্বকাপের কথা। একদিনের ক্রিকেটেই ৩৮০+ রান করে জেতার ঘটনা কম। মোটে একবার। সেটাও আজ কালের মধ্যে না। সেই ২০০৬ (১২ মার্চ) সালের কথা। অস্ট্রেলিয়ার করা ৪৩৪ রানের স্কোর টপকে ৪৩৮ রান করে ১ উইকেটের নাটকীয় জয় পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। খেলা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে। প্রোটিয়াদের টার্গেট ছিল ৪৩৫, ১ বল আগে জিতে যায় প্রোটিয়ারা।
এদিকে ফর্মের চূড়ায় থাকা সাকিব (৪১ বলে ৪১) আজ আর বড়সড় ইনিংস খেলতে পারেননি। টানা চার ম্যাচে দুটি করে হাফ সেঞ্চুরি আর সেঞ্চুরির পর আজ ফিরে গেছেন ৪০'র ঘরে। আগের ম্যাচের সহনায়ক লিটন দাসও আউট হয়েছেন ২০ রানে। ওপেনার সৌম্যর ব্যাট থেমেছে ১০ রানে।
তারপরও স্কোর ৩৩৩। সেটা সম্ভব হয়েছে মুশফিকের সংগ্রামী শতক (৯৭ বলে ১০২) আর অফফর্ম রিয়াদের তেজোদ্দীপ্ত ব্যাটিংয়ে (৫০ বলে ৬৯)। সাথে তামিমের ব্যাট থেকেও আগের চেয়ে আরও বড় ইনিংস (৭৪ বলে ৬২) বেরিয়ে এসেছে। আহত মোসাদ্দেকের বদলে সুযোগ পাওয়া সাব্বির (০) চরম হতাশ না করলে হয়তো রান সাড়ে তিনশো'তে গিয়ে ঠেকতো।
ওদিকে ফ্রন্টলাইন বোলারদের খারাপ দিনে উজ্জ্বল অনিয়মিত পেসার সৌম্য। তিন উইকেট দখল করে ঘাটতি পোষানোর প্রাণপন চেষ্টা করেছেন এ জেন্টল মিডিয়াম পেসার।
আশা ও স্বপ্নপূরণ না হলেও অধিনায়ক মাশরাফির একটা কথা সত্য হয়েছে। কাল প্রেস কনফারেন্সে চোয়াল শক্ত করে একটি কথা বলেছিলেন মাশরাফি, ‘আমরা ওয়ান ম্যান আর্মি না’- আজকের ম্যাচ প্রমাণ করেছে সত্যিই তো বাংলাদেশ এক সাকিবের ওপর নির্ভরশীল নয়। আজকের ম্যাচে অন্তত সেই সত্যের দেখা তো মিলেছে। সেটাই বা কম কিসে?
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুন ২১,২০১৯)