ধারাবাহিক উপন্যাস:পর্ব-তিন
সন্ধ্যা নামায় রাখি
রোকেয়া আশা
(পূর্ব প্রকাশের পর) ধরাধরি করে আফসানাকে ঘরে নিয়ে আসার পর ইসরাত কাঁদতে কাঁদতে তার বাবা মা কে জানায় আসলে কি হয়েছিলো।
" আপু থালাবাসন মাইজা পরে বাসন ধুয়ার লাইগা কলে চাপ দিতে নিছিলো। আপু কলের ডান্ডিতে চাপ দেওয়ার লগে লগেই ডান্ডিটা আপুর হাত থেইকা ছুইটা ঠাশ কইরা উপ্রে উইঠা আপুর নাকে বাড়ি মারছে। "
ফাতেমা বেগম ইসরাতের কথা শুনে শঙ্কিত বোধ করতে থাকেন। এমনিতেই আফসানাকে দিয়ে ঘরের কাজ করতে পাঠানোয় ইসরাতের বাবা তার ওপর রেগে আছেন ; তার ওপর কাজটা করতে গিয়ে এমন একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো।
ফাতেমা বেগম নিজের ভয় লুকোনোর কোন চেষ্টাই অবশ্য করেন না। সুন্দরী নারীর ভয়ার্ত চেহারার প্রতি পুরুষদের একটা আকর্ষণ আছে। জালাল উদ্দীন পুরুষ মানুষ। স্ত্রীর ভয়ার্ত মুখ দেখলে বেশি কিছু বলতে পারবে না।
ফাতেমা বেগম এরমধ্যেই জালাল উদ্দীনকে তাড়া দেন ;
" আপনে খাড়ায়া রইছেন ক্যান? তাড়াতাড়ি গিয়া আকবর ভাইরে নিয়া আসেন। "
আকবর হোসেন মানে গ্রামের একমাত্র ফার্মেসির মালিক। এখানকার স্থানীয় মানুষদের সবার জন্য তার ভূমিকা ছোটখাটো একজন ডাক্তারের মত। আকবর হোসেনের অবশ্য বয়স কম। বিয়ে শাদী করে নি এখনো। পরপর দুবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করার পর ওষুধের দোকানটা দিয়ে বসেছে। এবং তারপর থেকে ভালোই চলছে।
স্ত্রীর কথায় জালাল উদ্দীনের হুঁশ ফেরে। ভাগনিকে এরকম রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ভদ্রলোক একদম স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। আফসানাকে ঘরে আনার পরে ফাতেমা বেগমই ছোটাছুটি করে কাপড় ভিজিয়ে এনে মেয়েটার নাকে চেপে ধরে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করছেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আচ্ছন্নের মত ঘাড়টা একবার নেড়ে জালাল উদ্দীন ঘর থেকে বের হয়ে যান।
.
সুমার গায়ের রঙটা একটু কালোর দিকে। সেটাও সমস্যা ছিলো না, গ্রামের দিকে এমন চাপা গায়ের রঙ অনেকেরই হয়। কিন্তু আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে সুমা মোটাসোটা। শুধু মোটা না, বেশ মোটা। পনেরো ষোল বছর বয়সের কিশোরী মেয়ে এত মোটা কেন হবে? মোটাসোটা হবে চল্লিশ পেরোনো বড়লোকের ফর্সা বউয়েরা। দেখতেও কেমন ভালো লাগে। ফর্সা ফর্সা বয়সী বউগুলা যখন জামদানী আর গা ভরা গয়না পরে থপথপ করে হাঁঁটে, সে দৃশ্য দেখেও সুখ।
মেয়ের ভালো কোথাও বিয়ে হবে না, এ বিষয়ে সুমার বাবা মা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো। কিন্তু আল্লাহ কার তাকদীরে কি লিখেছেন কে বলতে পারে! তাই তো নাজিমদের মা ফট করে ঘুমের মধ্যে মরে গেলো। গিরস্থালি খালি খালি ফেলে রাখার জিনিস না। সুমাকে নাজিমদের আব্বা দেখেছে আগেও। একটু স্বাস্থ্যবতী মেয়ে যখন, গিরস্থালির কাজ হয়তো ভালোই করতে পারবে। এসব ভেবেই বউ মরার পরপরই নাজিমের আব্বা সুমার বাবা মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। প্রথমটায় একটু দোনোমোনো করলেও যখন তারা শোনেন ছেলেকে কিছুই দেওয়া লাগবে না, তখন তারা রাজি হয়েও যান। নাহলে অন্য কোথাও এই ধুমসি মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে ঘরের জিনিস আর সোনার গয়না তো দিতে হতোই, সাথে নগদ টাকাও দিতে হতো।
নাজিমের বাবার অবশ্য গিরস্থালির কাজ ছাড়াও আরেকটা গোপন উদ্দেশ্য ছিলো সুমাকে বিয়ে করার। নাজিমের মা ছিলো হাড় জিরজিরে। বিছানায় নারীদেহ মাংসল না হলে রমণে তিনি পুরো তৃপ্তিটা পান না। সুমার প্রতি আগ্রহের মূল কারণও ধরতে গেলে এটাই।
বিয়ের পরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আফসানাকে আর বাড়িতে আনা যাবে না। সুমার বয়স কম। আফসানার চাইতে বড়জোর চার কি পাঁচ বছরের বড় হবে। আফসানাকে এখানে রাখলে ওদের মধ্যে মা মেয়ের মত সম্পর্ক হবে না। সম্পর্ক হয়ে যাবে বান্ধবীর মত। আর নতুন মা আর বড় বোনের মধ্যে এরকম সম্পর্ক দেখলে ছেলেটাও বিগড়ে যাবে। নিজামের বাবা বুদ্ধিমান লোক। বাস্তবিক জ্ঞান তার যথেষ্ট টনটনে। সংসার ঠিক রাখার জন্য এসব ছোটখাটো এক দুইটা চাল চালাই যায়। অবশ্য আফসানার জন্য ওর মামাবাড়িতে তো মাসে মাসে টাকা পাঠাবেনই। আর দেখতে দেখতে তিন চার বছর গেলেই মেয়ের বিয়ে দিলেই শেষ। লোকটার যত চিন্তা সব ছেলেকে নিয়ে। নিজামের বয়স এখন একেবারে কম। এখনই যদি ওর কাছে সুমাকে মা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তাহলেই আর পরে কোন ঝামেলা হবে না।
সমস্যা হচ্ছে, নিজামও সুমাকে আগে থেকেই চেনে।
দ্বিতীয় বিয়েতে কোনরকম আড়ম্বর হয় নি, অবশ্য হওয়াদ কথাও না। শুধু মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আকদ পড়িয়েই নিয়ে আসা হয়েছে। সুমা বাড়িতে আসার পর থেকেই নিজাম কয়েকবার করে ওকে সুমা আপু বলেও ডেকে ফেলেছে। শেষবার সকালে কথা।
নিজামের আব্বা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতেই দুটো ছেলেমানুষি গলা তার কানে আসে।
" সুমা আপু, এই যে রুটিগুলা তুমি তিনটা উল্টানি দিয়াই বানায়া ফালাও? "
" হ। এই যে দেখ, একটা উল্টানি দিবি হাল্কা হাল্কা কাচা থাকতে। দুইবার উল্টানি দিবি রুটিটারে এইরকম ফুলানির পরে। "
নিজামের আব্বা স্ত্রী পুত্রের মধ্যে কথাবার্তা শুনে রাগে সাথে সাথেই হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
হোক বয়স কাছাকাছি, কিন্তু সম্পর্কে মা হয় যে, তাকে আপু কেন ডাকবে? আর এই মেয়েলোকেরই বা সমস্যা কি? নাজিম নাহয় ছেলেমানুষ, একটা ভুল করে ফেলেছে, ধুমসিটার তো আর বয়স কম হয়নি, সে কেন ছেলেটাকে ঠিক করে দিচ্ছে না?
নিজামের আব্বা তখন সাথে সাথেই রান্নাঘরে ঢুকে সুমার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে বের করে নিয়ে আসে। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজাম ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই সুমাকে ফেলে নিজাবের আব্বা ছুটে গিয়ে নিজামের ঘাড় চেপে ধরে।
" ও আব্বা! ছাইড়া দেও! ও আব্বা! "
নিজামের কাতর চিৎকার শুনে সুমা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে নিজামের আব্বা শিশুটিকে উঠোনের ধুলায় ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি মারছে।
নারী মাত্রেরই একটি সহজাত মাতৃত্বের প্রবৃত্তি থাকে। সৎছেলের প্রতি হতে থাকা এই আচরণ দেখে সুমা উঠে বসে। ও কিশোরী। সাংসারিক বাস্তববুদ্ধি থাকলে সুমা বুঝতে পারতো, যা হচ্ছে তা থামানোর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারতো লোকটার পায়ে ধরে বিলাপ করা। পুরুষমানুষ পায়ের কাছে পড়ে থাকা নারী দেখলে দয়ার্দ্র হয়ে ওঠে, এ তো সবাই জানে।
কিন্তু সুমা এই সাংসারিক কৌশলের ধার দিয়েও না গিয়ে একটা ভয়ংকর কাজ করে ফেললো। সে একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে জ্বলন্ত চুলা থেকে এক টুকরো লাকড়ি বের করে এনে ধা করে নিজামের আব্বার পিঠে একটা ঘা মেরে বসলো।
নিজামের আব্বা তখনই নিজামকে ছেড়ে দেয়।
অবিশ্বাসের চোখে সুমার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে একটাই বাক্য উচ্চারণ করে -
" মাগী এইডা কি করলি? " (ক্রমশ)
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুন ২৩,২০১৯)