ধারাবাহিক উপন্যাস:পর্ব-চার
সন্ধ্যা নামায় রাখি
রোকেয়া আশা
(পূর্ব প্রকাশের পর) কচ্ছপের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সে একবার উলটে গেলে নিজে নিজে সোজা হতে পারে না। অন্য কাউকে এসে কচ্ছপটাকে সোজা করতে হয়। নাজিমের আব্বার অবস্থা এই মূহুর্তে একটা উল্টে যাওয়া কচ্ছপের মতন। ব্যাপারটা এমন নয় যে সুমার আঘাতে তিনি খুব আহত হয়েছেন।
ভদ্রলোকের আহত বোধ করার কারণটা ভিন্ন। কিছুক্ষণ আগে নাজিমকে যখন মারতে মারতে উঠানে এনে ফেলেছিলেন, তখনই উঠানের আশপাশে ভীড় জমে গিয়েছিলো। পল্লীসমাজে অবশ্যই এটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এসব অতি স্বাভাবিক ঘটনা ঘটার সময় প্রত্যক্ষদর্শী হওয়াটাও দরকারি এদের জীবনে। অনেকটা রোজকার রান্নাঘরে তেল নুনের হিসাব মেলানোর মতো। রাতের বেলা পরিবারের সাথে বসে ভাত খেতে খেতে গল্প করার জন্য কথা পাওয়া যায়।
" বুবাইয়ের বাপ, হুনেন কতা। নাজিম পোলাডার লাইগা আমার এত মায়া লাগে, আহারে! "
চিরাচরিত নিয়মে এরপর ঘটনার বিবরণ, নিজের অভিমত প্রকাশ। অন্যপাশ থেকেও সাড়া আসার অপেক্ষা।
নাজিমকে পেটানোর সময় তাই পাড়ার অনেক মানুষ জড়ো ছিলো। এতগুলো মানুষের সামনে চৌদ্দ কি পনেরো বছরের একটা মেয়ে - যে কি না আবার তার সদ্য বিয়ে করা দ্বিতীয় পক্ষের নতুন বউ, এই একরত্তি মেয়েটা চুলা থেকে লাকড়ি এনে মেরে বসলো।
পুরুষ মাত্রই এই আঘাতটা সহ্য করতে পারবে না। অসংখ্য চোখের সামনে পৌরুষের গৌরব হারানোর আঘাত।
নাজিমের আব্বা খুব বিপন্ন বোধ করতে থাকেন। নিজের ঘরে বসে আছেন তিনি, উঠোন থেকে উৎসুক মানুষের ভীর সরে গেছে। এখন দুয়েকজন পড়শি বউয়েরা একটু করে উঁকি দিয়েই চলে যাচ্ছে।
সুমা নিজেই নাজিমের আব্বাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এসে বসিয়েছে। নাজিমকে বাজারে পাঠিয়েছে বড় দোকান থেকে বরফ নিয়ে আসার জন্য।
স্ত্রীর এই সেবাযত্নে নাজিমের আব্বা অবশ্য খুব প্রীত হচ্ছেন এমনও না।
তিনি ভাবছেন, এই ব্যাকা মেয়েমানুষকে ছেড়ে দেবেন কি না।
.
আকবর হোসেন বিস্মিতবোধ করছে। আফসানা নামের বালিকাটি দেখতে হুবহু তার মায়ের মত হয়েছে। আসলেই কি তাই?
তুলা দিয়ে সাবধানে মেয়েটার নাক পরিষ্কার করে সে। এখনো অজ্ঞান। তবে রক্তপাত খুব বেশিও হয় নি। দ্রুতই জমাট বেঁধে গেছে। অচেতন এই বালিকার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে বলে খুব ফর্সা লাগছে দেখতে। ওর মা এত ফর্সাও ছিলো না। নাকি মুখে রক্ত আসলেই আফসানাকেও ওর মায়ের মতন হলদে দেখাবে?
" কত দিমু কও। "
জালাল উদ্দীনের গলা শুনে বাস্তবে ফিরে আসে আকবর হোসেন।
সাথে থাকা বাক্সটা থেকে তিনটা ট্যাবলেটের পাতা বের করে। জালাল উদ্দীনের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে ওষুধের পাতার দিকে ইশারা করে।
" এই গোল বড়ি সকালে আর রাইতে খাওয়ার পরে, লম্বা প্লাস্টিকের বড়ি তিনবেলা খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে। আর এই তিনকোনা বড়িটাও সকালে আর রাইতে খাওয়ার পরে। "
ফাতেমা বেগম মাথা ঝাকিয়ে ট্যাবলেটের পাতা নেন।
আফসানার মুখের দিকে তাকিয়ে আকবর হোসেন খুব কোমল গলায় জালাল উদ্দীনকে বলেন,
" একদম পারভিনের মত হইসে না দেখতে? "
প্রশ্ন শুনে জালাল উদ্দীনও বালিকার মুখের দিকে তাকান। মৃত বোনের সাথে এই মুখের তেমন আদল খুঁজে পান না।
" কি কও মিয়া! আফসানা বাপের মত হইসে দেখতে। পারভিনের মুখ লম্বা আছিলো, আফসানার মুখ গোল। চোখমুখও মিলে না। "
খানিকটা বিরতি দিয়ে আবার বলেন, " তয় মিল আছে একটা। আমাগো পারভিনের মাইয়াও খুব সুন্দরী হইবো। "
আকবর হোসেন চুপ করে থাকে। কৈশোরের অতিপ্রিয় নামটা বুকের একপাশে এখনো বড্ড যন্ত্রণা দেয়। অথচ তখন বয়স আর কত ছিলো?
পনেরো বড়জোর।
আকবর হোসেন উঠে দাঁড়ায়। স্মিত হেসে বলে,
" টেকা দেওন লাগবো না। পারভিনের মাইয়া কি আমাগো কিছুই না? "
" ওষুধের দাম তো রাখবা মিয়া, নাকি তাও রাখবা না? " জালাল উদ্দীন স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে।
আকবর হোসেন কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
" ওষুধের দাম তো বেশি না। কিন্তু সেবারও তো একটা দাম আছে। একদিন বাড়িতে একটু ভালোমন্দ খাওয়াইয়ো নাহয়। "
জালাল উদ্দীন হেসে মাথা নাড়ে। সায় দেয়। আফসানার জন্য টাকা নিতে আকবরের কোথায় বাধছে তা যে তিনি জানেন না তা নয়। জানতেন। বাল্যকাল থেকেই জানতেন। সংসারে শান্তি রাখতে গেলে তারপরও এরকম জানা কথা না জানার ভান করে থাকতে হয়।(চলবে)
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুন ৩০,২০১৯)