দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : এ মুহূর্তে ক্রিকেটের বাতাসে শ্বাস নিলে বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ টের পাওয়া যায় সহজেই৷ ক্রিকেটের আড্ডায় কান পাতলে প্রবলভাবে বোঝা যায় আগ্নেয়গিরির উত্তাপ৷ যেন বিস্ফোরণের অপেক্ষা৷ যেন অগ্ন্যুত্‍পাতের প্রতীক্ষা৷ ইদানিংকালের বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথের আবহে টগবগে উত্তেজনা, উন্মাতাল উন্মাদনা, রক্তে শিহরণ ছড়ানো রোমাঞ্চ- কোনোটিরই তো অভাব নেই৷ ক্রিকেটের ‘নব্য মহারণ' হিসেবে প্রতি মুহূর্তেই যেন জায়গা করে নিচ্ছে এ লড়াই৷ মঙ্গলবার এজবাস্টনে দু'দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের আগে দু'দলের সমর্থকদের মাঝে এই যুদ্ধ যুদ্ধ সাজে তাই অবাক হবার কিছু নেই৷

অবাক করে বরং রেকর্ড বই৷ দুই যুযুধানের লড়াইয়ে সর্বশেষ ১১ ম্যাচেই তো লাল-সবুজ ছাপিয়ে বিজয়ী তেরঙ্গা৷ ভারত-পাকিস্তানের চিরকালীন দ্বৈরথকে তাহলে কিভাবে প্রতিস্থাপিত করবে বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক এ একপেশে পরিসংখ্যান? এখানেই ভিড় ঠেলে উঁকি দেয় সেই পুরনো প্রবাদ- পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা৷

ঠিক যে, ভারতের কাছে সর্বশেষ ১১ ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু এটিও ভুল নয়, এর অন্তত তিনটি ম্যাচে জিততে পারত বাংলাদেশ৷ জিততেই পারত৷ এ দেশের ক্রিকেটকাব্যে চিরন্তন দুঃখগাঁথা হয়ে থাকবে ম্যাচগুলো৷ স্মৃতির ক্যারাভানে চড়ে আরেকবার ঘুরে আসুন বেঙ্গালুরু, কলম্বো, দুবাইতে৷ ওই হারগুলোর কোনো ব্যাখ্যা পাবেন না৷ ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে শেষ তিন বলে চার উইকেট হাতে নিয়ে দুই রান করতে পারে না বাংলাদেশ৷ আবার কলম্বোয় ২০১৮ নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ বলে পাঁচ রানের সমীকরণ ঠিকই ছক্কায় মিলিয়ে দেন দীনেশ কার্তিক৷ দুবাইয়ের এশিয়া কাপ ফাইনালেও ভারতের শিরোপা জয় একেবারে শেষ বলে৷

অদ্ভুতুড়ে এই হারগুলো ভুতুড়ে স্মৃতির বেশে তাই বাংলাদেশকে তাড়া করবে অনন্তকাল৷

আবার ওই তিনটি ম্যাচই এজবাস্টনের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে মাশরাফির দলকে দিচ্ছে বিশ্বাসের জ্বালানি৷ এত কাছে গিয়ে এতবার হয়নি যখন, এবার তো হতেই পারে! আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়-সমর্থকদের তাতিয়ে দিচ্ছে আরো কিছু ঘটনা৷ ২০১৫ বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার নটআউট, মাহমুদ উল্লাহর আউট এবং ২০১৮ এশিয়া কাপ ফাইনালে লিটন দাসের আউট৷ বাংলাদেশের ভারত বৈরিতা শেকড় ছড়িয়েছে তাতেই৷

গেল বিশ্বকাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছে- এ নিয়ে সন্দেহ সামান্য৷ রোহিতের আউট, মাহমুদের নট আউটের সিদ্ধান্ত দুটো পাল্টে গেলেও ম্যাচের ফল বদলে যাওয়ার সাক্ষ্য অন্তত বাংলাদেশের ১০৯ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচ দেয় না৷ সেটি যতই মোমেন্টামের দোহাই তুলুন না কেন! আসলে সেবার ভারতের বিপক্ষে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে আ হ ম মুস্তফা কামালের আইসিসি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণাই আগুনে ঢালে ঘি৷ পরে এশিয়া কাপ ফাইনালে লিটনের আউট নিয়েও সেই ভারতের 'ক্ষমতা' দেখানোর অভিযোগ৷ সঙ্গে ‘তিন মোড়ল' তত্ত্বে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করা, দ্বিস্তরবিশিষ্ট টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে পরের স্তরে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা, নিজেদের দেশে সফরে না ডাকা- সব কিছুর মিলিত ফলই বাংলাদেশের ভারত-বিদ্বেষ৷

সব কিছুর জবাব দেবার মঞ্চ হিসেবে তাই মাঠের ক্রিকেটকেই দেখে বাংলাদেশের আমজনতা৷

তা এবারের বিশ্বমঞ্চে ভারতের মুখোমুখি হবার আগ পর্যন্ত খুব খারাপ করেনি মাশরাফির দল৷ সাত ম্যাচে ৭ পয়েন্ট৷ বৃষ্টিতে ভেসে গেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ৷ বাকি ছয় খেলায় জিতেছে তিনটিতে- দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে৷ বিশ্বকাপের আগের পাঁচ অংশগ্রহণে কখনোই এক আসরে তিনটির বেশি ম্যাচ জেতেনি বাংলাদেশ৷ এবার সে অর্জনের হাতছানি৷ শুধু তাই নয়, ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি জিতলে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা৷

বাংলাদেশ তাই তেতে থাকবে না কেন!


এখন পর্যন্ত ৬টি ম্যাচ মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ৷ আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচে বৃষ্টির কারণে একটি বলও মাঠে গড়ায়নি৷ এই ছয় ম্যাচে দুই সেঞ্চুরিসহ করেছেন ৪৭৬ রান৷ এক অপরাজিতসহ ৬ ইনিংসে সাকিবের গড় রানরেট ৯৫.২০৷ বোলিংয়েও সমান ভূমিকা রেখেছেন তিনি৷ ৬ ম্যাচে নিয়েছেন কার্যকরী ১০ উইকেট৷ ৪৬ ওভার বল করে ৫.৬২ ইকোনমি রেটে দিয়েছেন ২৯৮ রান৷

বিশ্বকাপে ভারতের লক্ষ্য তো আর বাংলাদেশের মতো না৷ শিরোপা জেতার জন্য তাঁরা ইংল্যান্ড গিয়েছে৷ বিরাট কোহলির দলের জয়রথ ছুটছিল অদম্য গতিতে; শেষ খেলায় প্রথম হোঁচট ইংল্যান্ডের কাছে হারে৷ তবু ১১ পয়েন্ট নিয়ে ভারতের সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত৷ বাংলাদেশের বিপক্ষে জিতে সেই ‘প্রায়' শব্দটি নিশ্চয়ই মুছে দিতে চাইবেন তাঁরা৷

তাই বলে বাংলাদেশকে মোটেই হালকাভাবে নেবার ভুল করছেন না কোহলি-রোহিত-বুমরারা৷ ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে গত দু-তিন বছর ধরেই শুনছি, বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে কেমন আলাদা সতর্ক থাকেন তাঁদের ক্রিকেটাররা৷ লাল-সবুজের সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা রয়েছে যে!

না হয় ১ টেস্ট, ৪ ওয়ানডে, ৬ টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে সর্বশেষ ১১ ম্যাচে সে সামর্থ্যের পূর্ণ প্রতিফলন নেই স্কোরবোর্ডে৷ দায় চুকানোর দায়িত্ব নিয়েই তাই এজবাস্টনে মাঠে নামবে বাংলাদেশ৷ সাম্প্রতিক ফলগুলো পাল্টে দেবার দায়, সেই তিন অদ্ভুতুড়ে ম্যাচের ক্ষতে প্রলেপ দেবার দায়, ভারতের ‘ক্ষমতা'র চর্চার জবাব দেবার দায়, বিশ্বকাপে টিকে থাকার দায় এবং আরো বড় ক্যানভাসে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথকে প্রতিস্থাপন করার দায়৷ পারবেন না মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিক-মুস্তাফিজরা?

১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি চোখ যে বড্ড আশাভরে চেয়ে আছে এজবাস্টনে! সূত্র: ডয়চে ভেলে

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/ জুলাই ০১,২০১৯)