আদালতের ভেতরেও ফোনে কথা বললেন ডিআইজি মিজান
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১১ টা। জামিনের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতের কক্ষে ঢুকেই ডান দিকের সারির শেষ বেঞ্চে বসলেন পুলিশের বরখাস্ত হওয়া উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান। পাশেই বসা ছিলেন তার আইনজীবী টিমের দুই জন জুনিয়র অ্যাডভোকেট। পেছনে ছিলেন ৮ থেকে ১০ জন পুলিশ সদস্য।
আদালতে ঢোকার পর স্বাভাবিকই ছিলেন তিনি! কনস্টেবল, এসআই ও ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছিলেন। এর পরপরই নিজের পকেট থেকে ফোন বের করলেন। সামনে থাকা আইনজীবীকে ফোন দিলেন। চারপাশ থেকে শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন। এরপর ফোন রাখেন পকেটে। কিছুক্ষণ পর পর আবার বের করে কথা বলছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনজীবীরা বললেন, একজন আসামি কোনোভাবেই পুলিশের হেফাজতে থেকে কথা বলতে পারেন না। অথচ ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা আদালতে জজের সামনে বসে ফোনে কথা বলছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডিআইজি মিজানের পকেটে থাকা ফোনটি তার বাড়িতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবলের। গতকাল রাত থেকেই তাকে দেয়া হয়েছে ফোনটি। এটাতেই যোগাযোগ করছেন তিনি।
কীভাবে একজন আসামি আদালতের ভেতর ফোনে কথা বলেন জানতে চাইলে পুলিশের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কেউ কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে আদালতের ভেতর স্বাভাবিক ছিলেন ডিআইজি মিজান। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতে ঢুকেই দেখা করেন তার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেন, ‘কী মিজান সাহেব, খবর কী? কেমন চলছে সব’। মিজান উত্তর দিলেন, ‘আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ওকে (ঠিক) আছি।’
এরপর শুরু হয় জামিন শুনানি। কাঠগড়ায় ওঠেন ডিআইজি মিজান। সেখানেও হাসিমুখ ছিল তার, ছিলেন আত্মবিশ্বাসী!
প্রায় ১ ঘণ্টার শুনানিটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন তিনি। একসময় বাম দিকে কাঠের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন।
শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজি মিজানুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশের পরও মুচকি হাসি দেন মিজান। চলে যান পুলিশের সঙ্গে গাড়িতে।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে কড়া নিরাপত্তায় শাহবাগ থানা থেকে ডিআইজি মিজানকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী জামিনের আবেদন করেন। আদালতে জামিনের পেছনে কয়েকটি ধারা বর্ণনা করলেও ‘মিজানকে অসুস্থ’ বলে দাবি করেন তার আইনজীবী।
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল তার জামিনের বিরোধিতা করেন। অসুস্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদালতে আসলে সবাই অসুস্থ হয়ে যায়।’ তার কথা শুনে আদালতের সবাই হাসতে থাকেন।
এর আগে সোমবার হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য গেলে ডিআইজি মিজানকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। এ সময় মিজানকে তাৎক্ষণিক হাইকোর্ট পুলিশের হাতে তুলে দেন আদালত। গ্রেফতারের পর তাকে শাহবাগ থানায় নেয়া হয়।
এ সময় হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, মিজানুর রহমান প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে পুলিশ বিভাগের ইমেজ ধ্বংস করেছেন। যেটা পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে কাম্য নয়।
এরপর আদালত তাকে গ্রেফতার ও মামলার অপর আসামি ডিআইজি মিজানের ভাগ্নে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসানকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য, মিজানুর রহমান ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীকে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়। নারী নির্যাতনের অভিযোগে গত বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়।
দুদক কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি সামনে আসার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজানকে সাময়িক বরখাস্তের একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। পরে ২৫ জুন মিজানুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করার প্রস্তাবে অনুমোদন দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
অন্যদিকে মিজানের ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পুলিশ প্রশাসন। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন। যদিও নারী নির্যাতন, ঘুষ প্রদান, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে দুই বছর ধরে মিজানুরের নাম আলোচনায় এলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২৪ জুন ৩ কোটি ৭ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় মিজানুর রহমান, তার স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না, ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান ও ভাগনে পুলিশের কোতোয়ালি থানার এসআই মো. মাহমুদুল হাসানকে আসামি করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ০২,২০১৯)