রিফাত-রিশান দুই ভাইয়ের যত কাণ্ড
বরগুনা প্রতিনিধি: রিফাত ফরাজী গ্রেপ্তার হয়েছে, রিশান গ্রেপ্তার হয়নি। সম্পর্কে এরা আপন দুই ভাই। দু’জনই বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি।
রিফাত-রিশান আপন এই দুই ভাই সরাসরি রিফাত শরীফ হত্যায় অংশ নিয়েছিল। নিহতের বাবা দুলাল শরীফের দায়ের করা মামলায় এই দুই ভাই পর্যায়ক্রমের ২য় ও ৩য় আসামি। মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বরগুনা থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে রিফাত ফরাজী। তবে রিশান এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রিফাত ও রিশান বরগুনা শহরের ধানসিঁড়ি সড়কের দুলাল ফরাজীর ছেলে। বরগুনা কলেজিয়েট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও ২০১৪ সালে বরগুনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে। এরপরই সে বরিশালের ইনফ্রা পলিটেকনিকে ভর্তি হয়। ভর্তির পরপর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে রিফাত। পরপর সেমিস্টারে অকৃতকার্য হওয়ার পর সে বরগুনায় চলে আসে। স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফরাজী। রিফাতের হাতে অসংখ্য মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছেন। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর রিফাতের কাছে ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব কারণে কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও অজ্ঞাত কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পায় সে।
২০১৭ সালের প্রথম দিকে ৪ নম্বর ওয়ারে ডিকেপি এলাকার ডাক্তারবাড়ী রোডের বাসিন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার বাসার সামনে বখাটেদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার প্রতিবাদ করায় ওই বাসায় রিফাত ফরাজীর নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। ওইসময় তারা দেলোয়ারের ঘরের আসবাবপত্র কুপিয়ে তছনছ করে হুমকি দিয়ে যায়। বর্তমানে ঝালকাঠি সদর থানায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রিফাত প্রতিনিয়ত নেশা করত এবং তার সঙ্গে অনেক প্রভাবশালীর ছেলেরা আড্ডা দিত। আমার বাসায়ও চাপাতি নিয়ে হামলা চালিয়েছিল রিফাত ফরাজী। ওই ঘটনার পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু কিছুদিন পরই সে ছাড়া পেয়ে যায়।’
২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় কুকুরের বাচ্চা নিয়ে বিরোধিতার জেরে তাহিদুল ইসলাম তারিক (২১) নামের এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে রিফাত ও রিশান। এ ঘটনার পরের দিন তারিকের বাবা মোঃ এমাদুল বাদী হয়ে ১৬ জুলাই বরগুনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৮ জুলাই তাকে আটক করে পুলিশ। কিন্ত মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে ছাড়া পায় রিফাত।
তাহিদুল ইসলাম তারিক বলেন, ‘কুকুরের বাচ্চা নিয়ে একদিন সামান্য কথা কাটাকাটি হয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে তার। তখন রিফাত ফরাজী আমাকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেয়। রিফাত ফরাজীর ভয়ে আমি দেড় মাস রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে বাসায় যাওয়া-আসা করতাম।’
একই বছর রিফাত ফরাজী বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যায়।
এ বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ডিকেপি রোডে আমাদের ভাড়া দেওয়া বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে রিফাত ফরাজী। এ ঘটনায় বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে পুলিশ রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে। পরে দুলাল ফরাজী রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি মোবাইল উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মারজানা মনি বলেন, ‘২০১৭ সালের রমজানে আমার একমাত্র ছোট ভাই হাফেজ মো. মেহেদী হাসান বরগুনার হোমিও চিকিৎসক আলাউদ্দিন ডাক্তারের বাসা সংলগ্ন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ায়। সে রমজানে মেহেদীর কাছ থেকে স্যামস্যাং গ্যালাক্সি কোর প্রাইম মডেলের বিদেশ থেকে আনা একটি ফোন ছিনিয়ে নেয় রিফাত ফরাজী। বিষয়টি রিফাত ফরাজীর মা-বাবাসহ স্থানীয় অনেককে জানানোর পরও আমার ভাইয়ের মোবাইলটি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারেননি। পরে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করার পর সাড়ে সাত হাজার টাকার বিনিময়ে মোবাইলটি ফিরিয়ে দিয়ে মেহেদীকে কোপানোর হুমকি দেয় রিফাত ফরাজী। ভয়ে ওই এলাকা ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে আসে আমার ভাই।
গত বছরের শেষের দিকে ক্রোক এলাকার এক লন্ড্রি ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করে রিফাত বাহিনী। লন্ড্রি ব্যবসায়ী বলেন, ‘ আমার বড় ভাইয়ের সাথে জনৈক মন্টু মিয়ার জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। ভাড়াটিয়া হিসেবে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে সে আমার ভাইকে মারতে এসে ভুলে আমায় মারধর করে। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফেরে।’
সম্প্রতি দীঘির পাড় এলাকায় আজিম মোল্লার ম্যাচে হানা দিয়ে ছাত্রদের মুঠোফোন কেড়ে নেয় রিফাত বাহিনী। আজিম মোল্লা জানান, মাস দুয়েক আগে আমার ম্যাচে হানা দেয় রিফাত বাহিনী। পরে আমি আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে একটি মোবাইল ফেরত আনি।
ক্রোক এলাকার জাকির হোসেন নামের এক বাসিন্দা জানান, বরগুনা পলিটেকনিকের ছাত্রদের ছাত্রাবাসে হানা দিয়ে মুঠোফোন ও ল্যাপটপ জিম্মি করে টাকা আদায় করা রিফাত ফরাজীর নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছিল। কেজি স্কুল এলাকার প্রায় সবগুলো ম্যাচের শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে অর্থ আদায় করেছে এই রিফাত ও তার বাহিনী।
কালাম মোল্লা, বাদল মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জানান, রিফাত প্রতিনিয়তই ম্যাচে হানা দিয়ে ছাত্রদের ফোন ল্যাপটপ জিম্মি করে টাকা আদায় করত।
কলেজে ছিল রিফাত-রিশান বাহিনী আতংক:
সকাল থেকে রিফাত বাহিনীর আনাগোনা ছিল বরগুনা সরকারি কলেজে। মেয়েদের উত্যক্ত করা, নতুন শিক্ষার্থীদের ০০৭গ্রুপের সদস্য করাসহ কলেজ ক্যাম্পাসে মাদকের আখড়া বসিয়ে ছিল রিফাত বাহিনী। ছোট ভাই রিশানের দায়িত্ব ছিল বন্ড গ্রুপের নতুন সদস্য যুক্ত করা এবং ঐ সদস্যদের পর্যবেক্ষণ করা। রিশান প্রায় প্রতিটি ঘটনায় যুক্ত থাকলেও খুব একটা প্রকাশ্যে আসতো না। কলেজ ক্যাম্পাসে আড্ডা ও বখাটেপনায় অতিষ্ঠ থাকলেও রিফাত বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না। বরগুনা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম বলেন, রিফাত বাহিনীর অত্যাচারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও তিনি আমলে নিতেন না।
বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ মুঠো ফোনে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোটখাট ঘটনা অহরহ ঘটে। আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসলে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি এদেরকে দুবার পুলিশে সোপর্দ করেছিলাম ।’
ঘটনার দিন কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন- জানতে চাইলি তিনি বলেন, ‘ঘটনা আমার ক্যম্পাসের বাইরে ঘটায় গুরুত্ব দেইনি। সন্ধ্যার পরে ভিডিও দেখার পর গুরুত্ব অনুধাবণ করি।’
এতসব ঘটনার হোতা রিফাত ফরাজী ও তার দলের বিরুদ্ধে কেউ মুখ না খোলায় তেমন একটা আইনের আওতায়ও আসেনি তারা। মামলা বা অভিযোগ তো দূরে থাক, কেউ এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেই সাহস পায়নি। যে মুখ খুলেছে তাকেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তবে মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরগুনা থানায় রিফাতের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আটক হলেও রাতারাতি জামিনে এসে ফের একই কাজে লিপ্ত ছিল এই বাহিনী।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ রিফাতকে বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করে এবং আদালতে হাজিরের পর তাকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় জড়িত সবশেষ ব্যক্তিটিকেও আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত আমরা অভিযান চালিয়ে যাবো। অপরাধিকে অপরাধি বিবেচনায় আমাদের কার্যক্রম চলবে, প্রভাবশালী বিবেচনায় না’।
উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে রিফাত শরীফকে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। গুরুতর জখম অবস্থায় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত শরীফ। হামলার আগের রাতে রিফাত ফরাজী জিরো জিরো সেভেন ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে হত্যার পরিকল্পনা ও সদস্যদের উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেয়। ঘটনার পর থেকে রিফাত ও রিশান উভয়ে পলাতক থাকলেও মঙ্গলবার রাতে কেবলমাত্র গ্রেপ্তার হয় রিফাত।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ০৪,২০১৯)