বোতল বিক্রি করে শত কোটি টাকার মালিক!
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: কাগজে-কলমে তিনি পরিবহন ব্যবসায়ী। দশ বছর আগেও রাস্তার পরিত্যক্ত বোতল বিক্রি করে চলতো তার সংসার। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে (বিহারি) জন্ম তার। নাম ইশতিয়াক আহমেদ।
পথেই হঠাৎ আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের সন্ধান! সেখান থেকে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ব্যবধান মাত্র ১০ বছর। এলাকায় দানবীর হিসেবেও বেশ সুনাম। তবুও পুলিশ কিংবা দুর্নীতি কমিশনের (দুদক) চোখে ফেরারি।
কারণটা সবার জানা। তিনি রাজধানীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এলাকায় ইয়াবা সম্রাট হিসেবেই খ্যাত। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, বেড়িবাঁধ, হেমায়েতপুর, আশুলিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় ইয়াবার ডিলারের ভূমিকায় ইশতিয়াক সিন্ডিকেট।
মোহাম্মদপুর থানায়ই রয়েছে তার বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যাসহ ১২ থেকে ১৫টি মামলা। পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতঘুরে ইশতিয়াক আহমেদ ও তার স্ত্রী পাখির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে এরই মধ্যে মিলেছে বিপুল সম্পদের খোঁজ। এ পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সম্পদ ও ব্যাংক হিসেবে বিপুল অর্থের সন্ধান মিলেছে। তবে ইশতিয়াক দম্পতিকে অনুসন্ধানকালে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পলাতক ইশতিয়াক দম্পতির ওই সব সম্পদের উৎসের কোন হদিস না পাওয়ায় দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারি পরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের সুপারিশে এরই মধ্যে কমিশন থেকে সম্পদের নোটিশ ইস্যু করার অনুমোদন মিলেছে। শিগগিরই ইশতিয়াক ও তার স্ত্রীর নামে সম্পদের নোটিশ দেওয়া হবে বলে সংস্থাটির জনসংযোগ দপ্তর নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে তদারককারী কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, কমিশন থেকে সম্পদের নোটিশের অনুমোদন মিলেছে। শিগগিরই ইশতিয়াক ও তার স্ত্রীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যদিও পুলিশ কিংবা স্থানীয় প্রতিনিধিরা তাদের হদিস দিতে পারে নি। এর আগে তাদের তলব করেও পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে ৩০ জুলাই দিয়াবাড়ীতে ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় ৮ দশমিক ২৮৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে আশুলিয়া থানার বিলমালিয়ায় ৩৪ লাখ টাকার ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন ইশতিয়াক দম্পতি। এরই মধ্যে দিয়াবাড়ীতে সাত তলা ও বিলমালিয়ায় এক তলা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। এছাড়া সাভারের বাইপাল থানায় চার শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। এখানেও ৬ তলা ভবন রয়েছে তাদের। আর এসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দুদকের হাতে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া দুদকের অনুসন্ধানে ইশতিয়াক ও স্ত্রী পাখির নামে এনআরবি ব্যাংকের আশুলিয়া শাখায় পৃথক হিসাবে ১৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯২৮ টাকা, ৫ লাখ ৬০ হাজার ও ৪৪ লাখ টাকার হাদিস পাওয়া যায়। অন্য একটি ব্যাংক হিসেবে মিলেছে সাড়ে ৪ হাজার ডলার। যদিও অভিযোগের উল্লেখিত সম্পদের তুলনায় অনেক কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ইশতিয়াক ও তার স্ত্রী পাখীর নামে পাওয়া এনআরবি ব্যাংক আশুলিয়া শাখা থেকে ঋণ গ্রহণের আবেদনপত্র, ব্যাংকে হিসাব খোলার আবেদনপত্র, ক্রেডিট কার্ড প্রাপ্তির আবেদনপত্র, মো. ইশতিয়াকের অনুকুলে ট্রেড লাইসেন্স, দাখিলকৃত টিন সার্টিফিকেট, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি খতিয়ে দুদক জেনেছে তিনি একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। শাহজালাল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামে একটি পরিবহন এজেন্সী রয়েছে।
তার দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন ও বিভিন্ন রেকর্ডপত্রে তিনি দাবি করেছেন, তার মাসিক আয় দুই লাখ টাকা, তার স্ত্রীর আয় মাসে ৫০ হাজার টাকা। ভাড়া বাবদ আয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোট মাসিক আয় ৫ লাখ টাকা এবং মাসিক ব্যয় ৬০ হাজার টাকা।
তবে দুদকের অনুসন্ধানে কোথাও তার কয়টি গাড়ী রয়েছে বা কিভাবে পরিবহনের ব্যবসা পরিচালনা করেন সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই দুদক মনে করছে তার ব্যবসা কাগজে কলমে। প্রকৃত অর্থে তিনি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং উক্ত আয়কে বৈধ করার জন্যেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। অবৈধ সম্পদকে বৈধ করতেই এতো আয়োজন। তবে ইশতিয়াক দম্পতিকে পাওয়া গেলে এবং আরো অনুসন্ধান করলে অবৈধ আরো অনেক সম্পদের হাদিস পাওয়া যাবে।
অনুসন্ধানকালে দুদক থেকে অভিযুক্ত ইশতিয়াককে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। হাজির না হলে পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১২ জুন জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এবং ইশতিয়াককে তলব করে আবারো চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি হাজির হননি। এমনকি কোথায় আছেন স্থানীয় মানুষ কিংবা লোকাল থানা কোনো হদিস দিতে পারেনি দুদককে।
মোহাম্মদপুর থানা অফিসার ইন চার্জ (ওসি) গনেশ গোপাল বিশ্বাস বলেন, ইশতিয়াক আহমেদ এখন কোথায় আছেন আমাদের জানা নেই। আমরাও তাকে খুঁজছি। তাকে পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইশতিয়াক জেনেভা ক্যাম্পের মাদকের মূল নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শহরের প্রধান ইয়াবা সরবরাহকারী। কক্সবাজার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান ওই সিন্ডিকের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। তার বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর থানায়।
দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুরের মাদক সম্রাট ইশতিয়াক তার ভাই মাহবুব ও নাদিমসহ আরো ১০০ জন কর্মচারীর মাধ্যমে ইয়াবা, গাঁজা এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্যের পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা অর্জন করেছেন। অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধানমণ্ডিতে চার কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, বনানী ও গুলশানে ২০ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, পূর্বাচলে একাধিক প্লট যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। এছাড়া তার স্ত্রীর নামে দুটি বিলাসবহুল গাড়ী রয়েছে ।
২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অভিযান চালালেও ইশতিয়াক তাঁর সহযোগীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে তার ছোট ভাই মাহবুবকে গ্রেপ্তার হয়। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর ডিএনসির সঙ্গে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, এপিবিএন ও এনএসআইয়ের ২০০ সদস্য মিলে জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ইশতিয়াকের প্রধান সহযোগী নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও মাত্র ১২ দিনের মাথায় ছাড়া পায় সে। তবে মাদক বিরোধী সারাশি অভিযানের ঘোষণার পর থেকে ইশতিয়াক সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্যই পলাতক রয়েছে বলে জানা যায়।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ০৪,২০১৯)