বরগুনা প্রতিনিধি: বরগুনা সরকারি কলেজের ভেতর থেকে রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে ধরে এনে কলেজের সামনের রাস্তায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনাটি বর্তমানে ভীষণ আলোচিত। এ ঘটনার সময় কলেজের সামনের রাস্তায় জনৈক ব্যক্তির দূর থেকে ধারণ করা ও ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি থেকে প্রকাশ্যে হামলাকারীদের ছবি পাওয়া গেলেও কলেজের ভেতর থেকে কারা রিফাত শরীফকে বের করেছিল তা কলেজের সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই কলেজের ভেতরে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে পুলিশও কোনও কথা বলতে চায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই দিনের খুনের ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে রিফাতকে কোপাতে যাদের দেখা গেছে, তাদের বাইরেও বন্ড বাহিনীর একটি দল কাজ করেছে কলেজের ভেতরে। হত্যাকাণ্ডের দিন রিফাত শরীফ তার স্ত্রীকে কলেজ থেকে নিয়ে যেতে আসেন।

কলেজের একটি সূত্র জানায়, বরগুনা সরকারি কলেজের ভেতরে নোটিশ বোর্ডের সামনে রিফাতকে প্রথম আক্রমণ করে বন্ড বাহিনী ও ০০৭ গ্রুপের সদস্যরা। এরপর সেখান থেকে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয় কলেজের বাইরে। আর সেখানেই পরবর্তী সময়ে নয়ন, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীসহ সন্ত্রাসীরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে। স্বাভাবিকভাবেই রিফাত শরীফকে কলেজ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য কলেজের সিসিটিভি ক্যামেরায় থাকার কথা। কিন্তু, এ ঘটনার কোনও দৃশ্যই কলেজের সিসিটিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। কোনও ফুটেজই পাওয়া যায়নি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কলেজ গেট থেকে ভেতরে ঢুকতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের দুটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এছাড়া কলেজে ঢুকে যেখানে রিফাত শরীফকে প্রথম মারধর করা হয়, সেখানেও একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এছাড়া কলেজের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১০-১৫টি সিসি ক্যামেরা রয়েছে, যেগুলো অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অধ্যক্ষের রুমে গিয়ে দেখা গেছে, যে মনিটর থেকে এসব সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তার ওপর একটি কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় অধ্যক্ষকে পাওয়া না গেলেও সেখানে কর্মরতরা বলেন মনিটর নষ্ট। কাপড় সরিয়ে মনিটর দেখতে চাইলে তা দেখতে দেননি তারা।

পরে বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ দাবি করেন, তাদের কলেজের সব ক্যামেরাই ভালো ছিল। কিন্তু, ২৪ জুন বজ্রপাত হওয়ার কারণে মনিটর নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে কোনও ফুটেজ ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

তবে কলেজ শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের দাবি, ২৪ জুন বরগুনা শহরে বজ্রপাতের কোনও ঘটনাই ঘটেনি। তাদের ধারণা, অধ্যক্ষই খুনিদের অপরাধ আড়াল করতে সিসিটিভি নষ্টের নাটক করছেন।

কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, আগে থেকেই কলেজের ভেতরে ছিল নয়ন বন্ড বাহিনী ও ০০৭ গ্রুপের ত্রাসের রাজত্ব। এখানেই তারা বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে টাকা আদায় করতো। নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করতো। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে মারধর করতো তারা।

অভিযোগ রয়েছে, কলেজ হোস্টেলে হানা দিয়ে হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী ছাত্রদের টাকার জন্য বিভিন্ন সময় মারধর করতো। টাকা না দিলে মোবাইল ল্যাপটপসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতো। কাউকে বলা কিংবা কারও কাছে অভিযোগ করলে ছাত্রদের ওপর চলতো পাল্টা নির্যাতন। এ বিষয়ে কলেজ অধ্যক্ষের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করলেও তিনি কোনও পদক্ষেপ নেননি।

এক শিক্ষার্থীর বাবা মজিবর হোসেন বলেন, ‘এ কলেজে এখন আর শিক্ষার পরিবেশ নেই। বহিরাগতরা কলেজে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে কখনও সুফল পাওয়া যায়নি।’

হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী বিভিন্ন সময় কলেজ-ক্যাম্পাসে ত্রাস ও ছাত্রদের হয়রানি করলেও আপনি কেন কোনও ব্যবস্থা নেননি জানতে চাইলে কলেজ অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছি। আর কোনও কথা বলতে চাই না।’ তারপর তিনি মোবাইল ফোনের কল কেটে দেন।

বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, ‘সরকারি কলেজে অনেক সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। এগুলো যদি সচল থাকতো তাহলে খুব সহজেই হত্যাকারীদের শনাক্ত করা যেতো। ’

বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে কিছু বিষয় আমাদের গোপন রাখতেই হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নি হামলাকারীদের বাধা দিয়েও স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি। রিফাতকে কুপিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকা ত্যাগ করে হামলাকারীরা। তারা চেহারা লুকানোরও কোনও চেষ্টা করেনি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন বিকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ২ জুলাই হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এছাড়া হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ জন ও এজাহারের বাইরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ০৬,২০১৯)