বন্ধ হচ্ছে পিপলস লিজিং
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খবরে আতঙ্কে রয়েছে আমানতকারীরা। আমানত ফিরে পেতে অনেকে ভিড় করছে পিপলস লিজিং অফিসে।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে রাজধানীর মতিঝিল সিটি সেন্টারের পিপলস লিজিংয়ের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন লোক অফিসের সামনে বসে আছেন। রিসিপশনে ছিলেন একজন কর্মী। সামনে সোফায় বসা তিন-চারজন লোক। ভেতরের দরজা বন্ধ। পান্স ছাড়া প্রবেশ করা যায় না। রিসিপশনের লোকটি জানালেন আজকে কোনো অফিসার নেই।
এর বেশি কথা বলা যাবে না। প্রয়োজন হলে পরে আইসেন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি সাহেব আসেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন স্যার আজকে অফিসে নেই।
এদিকে অফিসে অপেক্ষায় থাকা রশিদ নামের একজন আমানতকারী বলেন, আমাদের একটি সমিটির ৩০ লাখ টাকা পিপলস লিজিংয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু আমানতের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
অনেক বার সময় দিয়েছে কিন্তু টাকা দিচ্ছে না। আজকে পত্রিকায় দেখলাম পিপলস লিজিং বন্ধ করে দেয়া হবে। তাহলে আমাদের আমানতের টাকার কি হবে? আমাদের টাকা কিভাবে দেবে। আমরাতো সব নিয়ম মেনেই আমানত রেখেছি। আমাদের কষ্টের টাকা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে যাব।
এ রকম অনেক আমানতকারী সকাল থেকে পিপলস লিজিংয়ের মতিঝিল অফিসে এসে ভিড় করছেন। এসব বিষয়ে জানার জন্য পিপলস লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদার সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ও সরাসরি অফিসে গিয়ে জাগো নিউজের পরিচয়ে কথা বলতে চাইলেও তার দেখা মেলেনি।
পরে জানা গেছে, পিপলস লিজিং অবসায়নের সিন্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ায় ছোট ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী অফিসে আসে। আবার অনেকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চায়। আর এ কারণে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সকালে অফিস এসে পরে চলে যান।
এদিকে অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হচ্ছে এ বিষয়টি স্বীকার করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি শুনেছি। ঠিক আছে কিন্তু এ বিষয়ে না জেনে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, পিপলস লিজিংয়ে ঋণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা, সম্পত্তির ঝুঁকি ও তারল্য সংকটে দূরাবস্থায় রয়েছে। তারা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পরছে না। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরণ, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে আমানত রয়েছে দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো কোনো নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে। এছাড়া গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৭৪৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
তাদের মোট শেয়ারের ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ (৩) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের জন্য আদেশ দিতে পারবে।
একই আইনের ৮ ধারায় যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কারণে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে আমাতকারীদের স্বার্থহানি হয় এমনভাবে ব্যবসা করা, দায় পরিশোধে অপর্যাপ্ত সম্পদ, অবসায়ন বা কার্যক্রম বন্ধ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয়।
আর এজন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে তার উল্লেখ থাকে।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ১০,২০১৯)