প্রথমবারের স্বাদ নিতে মরিয়া ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড উভয়েই ‘প্রথম’ বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নামছে আগামীকাল রোববার। দ্বাদশ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে লড়বে স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দুই দলের কেউই কখনো বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের স্বাদ নিতে পারেনি। তিনবার ফাইনালে উঠলেও শিরোপার স্বাদ নিতে পারেনি ইংলিশরা। আর গেল আসরে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠলেও, রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় নিউজিল্যান্ডকে। তাই ‘প্রথমবারের’ মতো বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার সুবর্ণ সুযোগ ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সামনে।
ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডস স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট-বল হাতে লড়তে নামবে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। লর্ডসে ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায়।
১০টি দেশকে নিয়ে গত ৩০ মে লন্ডনের কেনিংটন ওভালে ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ দিয়ে পর্দা ওঠে দ্বাদশ বিশ্বকাপের। লিগ পর্বে প্রতিটি দল একে অপরের মুখোমুখি হয়। লিগ পর্বের মোট ৪৫টি ম্যাচ শেষে সেরা চার দল জায়গা করে নেয় সেমিফাইনালে। দলগুলো হলো— ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। শেষ চারে উঠতে পারেনি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তান।
ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে প্রথম সেমিফাইনালে ভারতকে ১৮ রানে হারায় নিউজিল্যান্ড এবং দ্বিতীয় সেমিতে ইংল্যান্ড আট উইকেটে হারায় অস্ট্রেলিয়াকে। ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম সেমিতে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় নিউজিল্যান্ড। ৪৬.১ ওভারে পাঁচ উইকেটে ২১১ রান তুলে চাপে ছিল নিউজিল্যান্ড। এরপর বৃষ্টির কারণে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। পরে আর খেলা শুরু না হলে, রিজার্ভ ডেতে গড়ায় ম্যাচটি। দ্বিতীয় দিন ভারতীয় বোলারদের নৈপুণ্যে ৫০ ওভারে আট উইকেটে ২৩৯ রানের বেশি করতে পারেনি কিউইরা। জবাবে ব্যাট হাতে নেমে মহাবিপদে পড়ে ভারত। মাত্র পাঁচ রানে তিন উইকেট এবং এক পর্যায়ে ৯২ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে বসে তারা। এতে নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ জয় ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু রবীন্দ্র জাদেজা ও মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটিং দৃঢ়তায় লড়াইয়ে ফেরে ভারত। কিন্তু শেষদিকে, জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ ও ধোনি ৭২ বলে ৫০ রান করে ফিরে গেলে জয়টা একেবারে নাগালের মধ্যে চলে আসে নিউজিল্যান্ডের।
দ্বিতীয় সেমিতে বার্মিংহামের এজবাস্টনে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং বেছে নেয় অস্ট্রেলিয়া। শুরু থেকেই ইংল্যান্ড বোলারদের তোপে পড়ে অসিরা। ১৪ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বসে তারা। শুরুর ধাক্কাটা পরে সামাল দিলেও, শেষ পর্যন্ত ৪৯ ওভারে ২২৩ রানে গুটিয়ে যায় অসিরা। অস্ট্রেলিয়ার ২২৪ রানের লক্ষ্য স্পর্শ করতে এতটুকুও হিমশিম খেতে হয়নি ইংল্যান্ডকে। ওপেনার জেসন রয়ের ৬৫ বলে ৮৫ রান ইংলিশদের জয় সহজ করে। ফলে সেমিফাইনাল জিতে বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকেট পায় ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড।
এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল ইংল্যান্ড। তিনবারই হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে ইংলিশদের। ১৯৭৯, ১৯৮৭ ও ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ইংল্যান্ড। তিনটি ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় ইংলিশদের। এরপর আর কোনো আসরের ফাইনালে উঠতে পারেনি ইংল্যান্ড। ১৯৯২ আসরের ২৭ বছর পর আবারো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল এউইন মরগানের দল। এবার শিরোপার স্বাদ নিতে উদগ্রীব এউইন মরগানরা। অবশ্য অন্যতম ফেবারিট হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
অথচ গত আসরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়েছিল ইংলিশদের। ওই বিদায়ের পর থেকে ক্রিকেট অঙ্গনে নিজেদের নতুনভাবে চেনাতে থাকে তারা। দুর্দান্ত ক্রিকেট নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আইসিসি র্যাংকিংয়ে ওপরের দিকে উঠে আসে ইংল্যান্ড। এক পর্যায়ে র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠে মরগান-রুট-স্টোকসরা। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া ইংল্যান্ড চার বছর পরের আসরের ফাইনালে। গেল চার বছরে ইংল্যান্ডের কতটা উন্নতি হয়েছে সেটিই সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মরগান।
সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটে হারানোর পর মরগান বলেন, ‘এটা স্পষ্ট, গত চার বছরে আমরা কতদূর এসেছি। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার পর যদি কেউ আমাকে বলতো চার বছর পর ফাইনালে ওঠার কথা, তবে আমি তা বিশ্বাস করতাম না। কারণ ওই আসরে যেভাবে আমরা বাদ পড়েছি, তা ছিল দুঃখজনক। তবে আমরা গত চার বছর অনেক পরিশ্রম করেছি। সে ফল আজ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব দেখছে আমরা এখন সেরার মুকুট পরা থেকে একা ধাপ দূরে।’
ফাইনালে ওঠার আনন্দ উচ্ছ্বসিত হলেও, শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ট্রফি জয়ের সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাতে চান মরগান। তিনি বলেন, ‘ফাইনালে উঠতে পেরে আমি সত্যিই উচ্ছ্বসিত। লর্ডসের ফাইনালটা আমাদের জন্য বড় একটি সুযোগ। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে এবং সেরা সাফল্য দিয়ে বিশ্বকাপ শেষ করতে হবে।’
দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দ্বাদশ বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু রেছিল ইংল্যান্ড। তবে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে হোঁচট খেলেও, এরপর টানা তিন জয়ের স্বাদ নেয় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের স্বাদ পায় তারা। হ্যাটট্রিক জয়ের পর টানা দুম্যাচ হেরে সেমিফাইনালে ওঠার পথ কঠিন হয়ে পড়ে ইংল্যান্ডের। তবে লিগ পর্বে শেষ দুই ম্যাচে ভারত ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড। নয় খেলায় ছয় জয়, তিন হারে ১২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তৃতীয় স্থানে থেকে শেষ চারের টিকেট নিশ্চিত করেন মরগানরা।
অন্যদিকে টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে নিউজিল্যান্ড। গত আসরের ফাইনালে উঠেও রানার্সআপ হয়ে বিশ্বকাপ শেষ করতে হয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে। মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে সাত উইকেটে হারে তারা।
গত আসরের আগে পাঁচবার সেমিফাইনালে উঠেছিল নিউজিল্যান্ড। কিন্তু কোনো আসরেই সেমির বাধা টপকাতে পারেনি কিউইরা।
এবারও সেমির বাধা টপকাতে বড় প্রতিপক্ষের সামনে পড়েছিল নিউজিল্যান্ড। লিগ পর্বের সেরা দল ভারত ছিল শেষ চারে নিউজিল্যান্ডের প্রতিপক্ষ। বৃষ্টিতে গড়ানো দুদিনের সেই সেমিতে বোলারদের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে ১৮ রানে জয় নিয়ে বিশ্বকে চমকে দেয় কেন উইলিয়ামসনের দল। লিগপর্বে নয় খেলায় ১৫ পয়েন্ট নিয়ে সেরা দল হয়েছিল ভারত। আর নয় খেলায় পাঁচ জয় তিন হার ও একটি পরিত্যক্ত ম্যাচ থেকে ১১ পয়েন্ট নিয়ে নিউজিল্যান্ড ছিল চতুর্থস্থানে।
বড় জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল নিউজিল্যান্ড। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১০ উইকেটের জয় পায় তারা। শুভ সূচনার পর টানা দুই জয় তুলে নেয় কিউইরা। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হলেও, পরের দুম্যাচ জিততে বেগ পেতে হয়নি নিউজিল্যান্ডের। ফলে প্রথম ছয় ম্যাচ থেকে পাঁচ জয়ের ১০ পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালে খুব কাছে পৌঁছে যায় উইলিয়ামসন-বোল্টরা। কিন্তু লিগপর্বে নিজেদের শেষ তিন ম্যাচেই হেরে সেমির পথ কঠিন করে ফেলে নিউজিল্যান্ড। ফলে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের ম্যাচের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় কিউইদের। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান জিতলে নিউজিল্যান্ডের সমান ১১ পয়েন্ট হয় তাদেরও। কিন্তু রানরেটে এগিয়ে থাকার সুবাদে শেষ দল হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠে নিউজিল্যান্ড।
সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নেমে অসাধারণ এক জয় তুলে নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত ফাইনালে ওঠে নিউজিল্যান্ড।
দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয়ের সুযোগ তৈরি হওয়ায় দলের খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব দেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।
তবে গেলবার না পারলেও, এবার শিরোপা জিততে বদ্ধপরিকর কিউই অধিনায়ক বলেন, ‘আবারো আমাদের সামনে বিশ্বমঞ্চে সেরা হওয়ার সুযোগ এসেছে। আগের আসরে আমরা সুযোগ হাতছাড়া করেছিলাম। এবার আর সেটি করতে চাই না। দলের সবাই শিরোপা জিততে মুখিয়ে আছে। আমি মনে করি, আমরা সেরাটা দিতে পারলে এবারের শিরোপা আমাদেরই হবে।’
এবারের আসরে লিগ পর্বে চেস্টার-লি-স্ট্রিটে মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। ওই ম্যাচে ইংল্যান্ডের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি কিউইরা। ১১৯ রানের বিশাল ব্যবধানে ম্যাচ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামে ইংল্যান্ড। ওপেনার জনি বেয়ারস্টোর সেঞ্চুরিতে ৫০ ওভারে আট উইকেটে ৩০৫ রানের বড় সংগ্রহ পায় ইংলিশরা। ১৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৯৯ বলে ১০৬ রান করেন বেয়ারস্টো।
জবাবে ৪৫ ওভারে ১৮৬ রানেই গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস খেলতে দেয়নি। ইংল্যান্ডের পেসার মার্ক উড ৩৪ রানে ৩ উইকেট নেন। এবার বিশ্বকাপের ফাইনালে আরো একবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লড়তে হবে ইংলিশদের। সেই মঞ্চের আবহ বেশ ভালোই জানে নিউজিল্যান্ড। কারণ চার বছর আগের আসরে ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। এ ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে ইংল্যান্ড। ম্যাচের হিসাবে ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা বেশি ইংলিশদের হলেও, সেই অভিজ্ঞতা ২৭ বছর আগের। প্রায় তিন দশক আগে খেলা সে ফাইনাল, আর এ যুগের ফাইনাল খেলার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। তবে নিজেদের কন্ডিশনের সুবিধা সঙ্গে থাকায় একটু হলেও হয়তো লড়াইয়ে এগিয়ে থাকছে ইংল্যান্ড।
ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত ৯০টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ড ৪৩টিতে, আর ইংল্যান্ড ৪১টিতে জয় পেয়েছে। দুটি ম্যাচ টাই ও চারটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়।
ইংল্যান্ড দল : এউইন মরগান (অধিনায়ক), মঈন আলি, জোফরা আর্চার, জনি বেয়ারস্টো, জশ বাটলার, টম কারান, লিয়াম প্লানকেট, লিয়াম ডসন, আদিল রশিদ, জো রুট, জেসন রয়, বেন স্টোকস, জেমস ভিঞ্চ, ক্রিস ওকস ও মার্ক উড
নিউজিল্যান্ড দল : কেন উইলিয়ামসন (অধিনায়ক), টম ব্লানডেল, ট্রেন্ট বোল্ট, কলিন ডি গ্র্যান্ডহোম, লোকি ফারগুসন, মার্টিন গাপটিল, ম্যাট হেনরি, টম লাথাম, কলিন মুনরো, জেমস নিশাম, হেনরি নিকোলস, মিচেল স্যান্টনার, ইশ সোধি, টিম সাউদি ও রস টেইলর।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই ১৩,২০১৯)