‘আইরিশ’ মরগানের ইংলিশ অধিনায়ক হয়ে ওঠার গল্প
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: মাত্র ১৫ বছর বয়সে উইয়ন মরগান ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে অনেক আগেই। এখন তাকে হাতছানি দিচ্ছে ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হওয়ার কীর্তি।
লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল জিততে পারা হয়ে উঠতে পারে মরগানের জীবনের চরমতম প্রাপ্তি। এই কীর্তির এতো কাছে চলে আসার পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন মরগানের বাবা জডি মরগান। ছেলের বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখনই আয়ারল্যান্ডের প্রধান কোচ অ্যাড্রিয়ান বাইরেলের সাথে আলোচনা করে ছেলের ভবিষ্যত পথরেখা ঠিক করেছিলেন তিনি।
‘ওই আলোচনাটা ছিলো মরগান কিভাবে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারে, তা নির্ধারণ করা। আয়ারল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ এবং মিডলসেক্সের হয়ে খেলে মরগান কিভাবে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, আমরা সে বিষয়ে কথা বলেছিলাম। সেটাই ছিলো মরগানের স্বপ্নের শুরু।’- সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন বাইরেল।
এরপর মরগানের স্বপ্ন নানা রঙের পসরা সাজিয়ে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। ঠিক সে সময়ে, মরগান কেবলই এক স্বপ্নবাজ তরুণ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন তার চেয়েও বড় কিছু। স্বপ্ন পূরণের তীব্র ইচ্ছা এবং সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার আকাঙ্খা তাকে নিয়ে যেতে থাকে সতত সামনের দিকের।
একদম আয়ারল্যান্ডের তৃণমূল পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করায় মরগানের অভিজ্ঞতা তার সমবয়সী ইংলিশ ও অস্ট্রেলীয় কিশোরদের চেয়ে বেশি ছিলো বলে মন্তব্য করেন বাইরেল।
ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে আয়ারল্যান্ড তেমন বড় নয়, কিন্তু মরগানের প্রতিভার বিকাশ ঘটার ক্ষেত্রে তা কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের কয়েকটি টুর্নামেন্টেই মরগানের প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছয়শর বেশি রান করে হৈচৈ-ও ফেলে দিয়েছিলেন মরগান। এরপর আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলে খেলেও নিজের প্রতিভার প্রমাণ রেখেছেন তিনি।
ইংল্যান্ডের সাবেক কোচ পল ফারব্রেস মরগানের বেড়ে উঠার সময়ের স্বাক্ষী। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৫ দলের দায়িত্বে ছিলাম মরগান তখন খেলে আয়ারল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। তখন সে ২০- ৩০ রান করে আউট হয়ে গেলেও খেলতো দারুণ। আমি তখন মিডলসেক্সকে বলেছিলাম এই ছেলের ভবিষ্যত আছে।’
ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলের কোচ থাকাকালীন ফারব্রেস চার বছর ধরে মরগানকে দেখেছেন। মরগান তখন ছিলেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের নিয়মিত প্রতিপক্ষ। চলতি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময় পেছনের দিনগুলোর কথা মনে করে ফারব্রেস বলেন যে, মরগান যা করে এসেছেন, তা দুর্দান্ত।
তার মতে, ইংল্যান্ডকে মরগান কেমন দেখতে চান, তা কেবল মুখে মুখে বলেই ক্ষান্ত হননি মরগান। বরং সবার আগে নিজের কাজটা ঠিকঠাক করেছেন। যা অন্যান্য খেলোয়াড়দের কাছে তাকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করায়। একই সাথে, ম্যাচ জেতার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা নেয়া এবং যা করা উচিত হবে, মরগান ঠিক সে কাজটাই করেন।
ফারব্রেস বলেন, ‘মরগান সেটাই করে যা সে বলে। সতীর্থদের ভালো খেলার নির্দেশনা দেয়া সহজ, কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তা করে দেখানো কঠিন। মরগান যদি এক্সট্রা কাভারের দিকে খেলতে গিয়ে বাজেভাবে আউট হয়, তখন তার দল বুঝে নেয় যে, মরগান সেটাই করছে, যা সে বলেছে। দলও একইভাবে নিজের কথা আর কাজের মিল দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে যায়। এর জন্যই ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। ইংল্যান্ড মরগানের ব্যক্তিত্বের শক্তিতে লাভবান হয়েছে। মরগানের সামর্থ্যবান মানসিক দৃঢ়তা সব সময়ই তার দলকে চাঙ্গা রাখে। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, সে ছিলো লাল চুলওয়ালা ছোট এক কিশোর যে জানতো সে কী করতে চায়। সেই অবস্থা আসলে এখনো খুব একটা বদলায়নি।’
হ্যাম্পশায়ারের বর্তমান প্রধান কোচ মরগানের ছোটবেলার কথা স্মরণ করে বলেন, মরগান ছিলেন দারুণ স্বাধীনচেতা এক কিশোর।
মরগানের ছোটবেলা কেটেছে সেন্ট ক্যাথরিন স্টেটসে। যেখানে তার বাবা-মা ছয় সন্তানকে তিন বেডের ছোট এক বাড়িতে থাকতেন। মরগানদের পরিবার ছিলো ক্রিকেট পাগল। কতোটা পাগল তা বোঝা যায় মরগানের বাবার কথায়, তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন যে, তিনি তার ছোট সন্তানের জন্মের দিন তার স্ত্রীর সাথে ছিলেন না, কারণ ওই দিন আয়ারল্যান্ডের খেলা ছিলো!
তাদের পরিবারের ক্রিকেট পাগলামি যে নিছক পাগলামি নয়, তা বোঝা যায় ইয়ন মরগানের দুই বোন লরা মরগান ও জিওন মরগানের আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার সাফল্যের মাধ্যমে।
মরগান পরিবারে ক্রিকেট নিয়ে এমন উন্মাদনা থাকলেও, তা কিন্তু মরগানদের এলাকায় ছিলো না। বরং তাদের এলাকা ছিলো হাউলিং দ্বারা প্রভাবিত। এই খেলা বলতে পাগল ছিলো মরগানদের এলাকার লোক। তারা মরগানদের অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বলতো কেনো তারা ক্রিকেটের মতো ব্রিটিশ একটা খেলা খেলে।
থমিক ক্রিকেটটা মরগান খেলতে শুরু করেন বাড়ির পাশের ছোট ফাঁকা জায়গা। যেখানে বিয়ারের বোতল রাখার ছোট ছোট কেস ছিলো তার স্টাম্প।
মরগান যখন মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়েন, তখন তার বাবা ট্রাইনিটি কলেজ স্পোর্টস কমপ্লেক্সে গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। সেই কাজের সূত্র ধরে মরগান তার স্কুল ও ক্লাব পরিবর্তন করেন। নিজের আগের এলাকা থেকে তারা উত্তরাঞ্চলের উপশহর স্যান্ট্রিতে চলে যান। ক্রিকেটখেলুড়ে ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মরগান। সুযোগ পান আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ক্লাম মালাহাইডে। এই পর্যায়ে তিনি ব্রায়ান ও’রোর্কের অধীনে খেলতে থাকেন। ব্রায়ান তখন লেইন্সটার ও আয়ারল্যান্ড যুব দলের কোচ ছিলেন।
‘সফল হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা মরগানকে তার আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে তার ছিলো অমিত প্রতিভা। মরগানকে দেখতান ডাউন দ্য উইকেটে এসে স্পিনারদের উড়িয়ে উড়িয়ে বাউন্ডারিতে মারতো। একদম প্রথম বল থেকেই বোলারদের শাসন করার মানসিকতা ছিলো তার। এটা নিশ্চিত করতে যদি একটু-আধটু ঝুঁকিও নেয়ার প্রয়োজন পড়তো, সে নিয়ে নিতো।’ - ব্রায়ান ও’রোর্ক।
আয়ারল্যান্ড দলে মরগানকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন নায়াল ও’ব্রায়েন। তার মতে, মরগান হলো সেই ক্রিকেটার যে সব সময় মাঠে সেরা ক্রিকেটার ছিলো। আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলা ২৩ ম্যাচে মরগানের স্ট্রাইকরেট ছিলো ৭১.৬৭। আর ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ২০৮ ম্যাচে তার স্ট্রাইকরেট ৯৪.১৯।
২০১১ সালের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে দুই লাখ ২০ হাজার পাউন্ডের চুক্তিতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেন মরগান। কিন্তু আসরের মাঝপথে তিনি ফিরে যান ইংল্যান্ড এবং ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৩ রানের ইনিংস খেলে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের পথ সুগম করেন।
ব্যক্তি মরগানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো তিনি যা ভালো মনে করেন, তা করতে দ্বিধা করেন না। যেমন বাংলাদেশে ইংল্যান্ডের সর্বশেষ সফরে তিনি আসেননি। নিরাপত্তাজনিত কারণে ওই সফর থেকে নাম তুলে নেয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন তিনি।
নিজের কাজ ও কর্মের প্রতি এ রকম অবিচলতাই তাকে তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। এখন যদি বিশ্বকাপটা জিততে পারেন, তবে চিরদিনের জন্য তার উঠে যাবে গ্রেট অধিনায়কদের তালিকায়। মরগান নিশ্চয় মনে-প্রাণে এই লক্ষ্যটাই পূরণ করতে চাইছেন এখন।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ১
,২০১৯)