ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-পাঁচ
সন্ধ্যা নামায় রাখি
রোকেয়া আশা
(পূর্ব প্রকাশের পর) আফসানা গুঙিয়ে ওঠে। অল্প অল্প ঠোঁট কাপছে মেয়েটার। জালালউদ্দীন ব্যস্ত হয়ে স্ত্রীকে ডাকতে থাকেন।
" ইসরাতের মা! জলদি আহো! "
আকবর হোসেন হাসে, জালালউদ্দীনের কাঁধে হাত রেখে বলে,
" এত ব্যস্ত হওনের কিছু নাই। বেশি ক্ষতি হয় নাই মাইয়ার। কয়দিন একটু দুধ ডিম খাওয়াইয়ো ভালোমতন। "
জালালউদ্দীন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন। কাঁধে বসে থাকা আকবরের হাতটা নিজের দুহাতের মুষ্ঠিতে চেপে ধরেন। আকবর হোসেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। ঠিক এই দৃষ্টি সে বহুবছর আগেও একবার এই মানুষটার চোখে দেখেছিলো। পারভিনের বিয়ের রাতে।
ফাতেমা বেগম ঘরে ঢোকেন ধীরপায়ে। পুইঁশাকের চারা লাগিয়েছিলেন সদ্য, এইটুকু সময় ঘরে থাকতে না থাকতেই ছাগল এসে চারাগুলোয় মুখ দিয়ে দিয়েছে। মহিলা কিছুটা বিরক্ত বোধ করছেন। ভালোরকম বিরক্তই বোধ করছেন। তারপরও নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার একটা চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন, আফসানার জায়গায় তো ইসরাতও থাকতে পারতো। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তিনি এভাবে এতটা বিরক্ত বোধ করতেন না।
" ইসরাতের মা, দুধ পানাইছো আজকে? "
স্বামীর ডাকে চমকে উঠে তাকান ফাতেমা বেগম। মনে মনে তার এখন বিরক্তির পাশাপাশি লজ্জাও কাজ করছে। মা মরা মেয়েটা এখানে এভাবে পড়ে আছে, আর তিনি কিনা পুইঁশাকের নতুন চারার জন্য মেয়েটার অজ্ঞান হওয়া নিয়ে বিরক্ত হচ্ছেন - ভাগ্যিস, মানুষ অন্য মানুষের মনের কথা শুনতে পায় না!
" জ্বি, বলেন! " ফাতেমা বেগমের গলার স্বর অবনত হয় আরও। হয়তো, তার ভেতরের দ্বন্দ্বের জন্যই।
" জিগাইছিলাম দুধ পানাইছো নাকি? "
" জ্বি না। বাছুরটারে নিয়া যাবো এখন, তারপরেই পানায়া ফেলবো। "
" আচ্ছা, দুধটা পানানো হইলে আফসানার লাইগা এক গেলাস দুধ নিয়া আইসো। মাইয়াটার একটু দুধডিম বেশি কইরা খাওয়ানো লাগবো এহন। "
ফাতেমা বেগম বুঝে উঠতে পারেন না, হঠাৎ করেই তার এত ঈর্ষাবোধ হচ্ছে কেন। নিজের শৈশবের সাথে আফসানার কপালের কিছুটা মিল থাকলেও আফসানা তার মত ভুগছে না বলে - নাকি ইসরাতের, তার নিজের সন্তানের সাথে পরের এক মেয়ে ভাগীদার হিসেবে জুটে গেছে বলে। কিসের ভাগীদার? দুধের গ্লাসের?
কিছুটা ঈর্ষা আর কিছুটা অনুতাপের সাথে ফাতেমা বেগম মাথা নেড়ে ক্ষীণকন্ঠে বলেন,
" জ্বি, আচ্ছা। "
সুমা ভয় পাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয়। নাজিমের আব্বা সকাল থেকেই মুখ বন্ধ করে বসে আছে। সকাল বেলায় ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলার সময় সুমা নিজেও টের পায়নি যে সে কি করছে। সুমার শুধু মনে আছে উঠোনে একটা শিশুর খুব করুণ স্বরে চিৎকার করার শব্দ। কেন যেন সেই স্বর সুমা উপেক্ষা করতে পারে নি। সাংসারিক বোধবুদ্ধি সুমার কম। কম হলেও সে এটুকু বুঝতে পারছে, মাঝেমধ্যে সংসার টেকানোর জন্যই কিছু আর্তস্বর উপেক্ষা করে যেতে হয়। সংসারে সব নিষ্ঠুরতার বিচার স্বীকৃত না। আপন বাবা সন্তানের সাথে যা খুশি করতেই পারে, একজন সৎমায়ের কোন অধিকার নেই সেসব থামাতে যাওয়ার।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। সুমা খুব ভয়ে ভয়ে রান্নাবান্না সেরে নাজিমের আব্বার চৌকির পাশে এসে দাঁড়ায়।
" রান্ধা শেষ। আপনি খাইবেন না? "
নাজিমের আব্বা তার টকটকে লাল চোখ দুইটা তুলে সুমার দিকে তাকাতেই সুমা কুকড়ে যায় আরও।
নাজিমের আব্বার তখন মনে চিন্তার ঝড়। এই মেয়েটার কলিজা আছে। কিন্তু মেয়েমানুষের তো কলিজা থাকাও ভালো না।
সুমাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় সেই চিন্তা করতে করতে নাজিমের আব্বার চোখ যায় সুমার বুকের দিকে। অল্পবয়স হওয়ায় এখনো শাড়িটা গুছিয়ে পরতে শেখে নি মেয়েটা। শাড়ির আচল যে কখন একপাশে সরে গেছে খেয়ালই নেই ; অনভ্যস্ততায়, নাকি ভয়ে - বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটার শরীর বয়সের তুলনায় অনেক পূর্ণ। বিয়ের পর মেয়েটাকে বাড়িতে আনার সময় ওর ঋতুকাল চলছিলো। এখনো পর্যন্ত বিছানায় সুমা কেমন হবে সেই স্বাদটাই নেওয়া হয়নি নাজিমের আব্বার।
কেন যেন, সুমার অবিন্যস্ত বুকের দিকে তাকিয়ে নাজিমের আব্বার মনটা নরম হয়।
" সুমা - "
সুমা খুব ভয়ে আরও জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকে শাড়ির আচলটা ঠিকঠাক করেও নেয়। নাজিমের আব্বা বিরক্ত হয় কিছুটা। স্বামীর সামনে আবার এত পর্দা কিসের?
গলাটা তারপরও কিছুটা নরম রাখে ভদ্রলোক।
" নাজিম কই? অয় কিছু খাইছে? " (চলবে)
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/জুলাই২১,২০১৯)