রিফাত-রিশান কেন এত আগ্রহী ছিল?
বরগুনা প্রতিনিধি: চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে এ পর্যন্ত মামলার প্রধান সাক্ষী ও তাঁর স্ত্রী মিন্নিসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ২৬ জুন এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এর পরেরদিন নিহতের বাবা দুলাল শরীফ বাদি হয়ে বরগুনা সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন।
মুঠোফোনে ধারণ করা হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য (ভিডিও) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপি নিন্দার ঝড় ওঠে। ভিডিওতে রিফাত শরীফকে দুর্বৃত্তদের হামলার সময় তাঁকে বাঁচাতে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে প্রাণপন চেষ্টা করতে দেখা যায়।
ওই ভিডিওতে রিফাত শরীফকে আঘাতকালে দুই ভাই রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীকে অগ্রভাগে দেখা গেছে। এতে দেখা যায় ছোট ভাই রিশান পেছন দিক থেকে রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে ছিলেন। আর বড় ভাই রিফাত দা দিয়ে কোপাচ্ছেন। তখন বড় ভাইয়ের দায়ের আঘাতে রিশানের হাতও অনেকটা কেটে গিয়েছিল। রিফাত শরীফকে কোপাতে এ দুই ভাইকেই বেশি তৎপর দেখা গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, রিফাত-রিশান কেন এতো আগ্রহী ছিল? রিফাত শরীফের ওপর কেনইবা দুই ভাই নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাত করেছে। যারা রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীকে চেনেন, তাদের অনেকেই বলছেন যে দুই ভাইয়ের এই নির্মমতার নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে।
রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। একটি গ্রুপ নয়ন বন্ডের গড ফাদার হিসেবে বরগুনা -১ আসনের সাংসদপুত্র সুনাম দেবনাথকে দোষারোপ করতে থাকেন। আবার রিফাত ও রিশান ফরাজীর মদদদাতা হিসেবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনকে দোষারোপ করা হয়।
ঘটনার পর মিন্নি গত ১৪ জুলাই তার বাবার বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন। এর আগের দিন তাঁর শ্বশুর আবদুল হালিম সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূ জড়িত অভিযোগ করে মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি করেছিলেন। পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে মিন্নি বলেন, কলেজ গেটের সামনে পেয়ে রিশান প্রথমেই রিফাত শরীফের পথরোধ করে। রিশান দাবী করে বলে, রিফাত শরীফ তার মাকে (খুকি) অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। কেন করেছে তা জানতে চায়। ঠিক একই সময় রিফাত ফরাজী বলেন, তুই (রিফাত) আমার চোখের দিকে তাকাইয়া ক-, মাকে কেন তুই গালি দিয়েছো। তখন রিফাত-রিশানের সঙ্গে থাকা অপর আসামিরা রিফাতের কাছে অস্ত্র আছে- এমন মন্তব্য করে, ধর ধর বলে কিলঘুষি শুরু করে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রিফাত ও রিশান ফরাজী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। সে হিসেবে দেলোয়ারের স্ত্রী তাদের খালা। কিন্তু সম্পর্কে খালা হলেও ছোটবেলা থেকেই তাকে মা ও খালুকে বাবা বলে ডাকে তারা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শহরের রাসেল স্কয়ার সড়কে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নিজস্ব বাসা। এই বাসায় প্রবেশের বা দিকে চেয়াম্যানের মালিকানাধীন স্টল। সেটি ভাড়া নিয়ে এক ব্যবসায়ী মাটিয়াল ক্যাফে অ্যান্ড মিনি চাইনিজ নামে একটি খাবারের দোকান করেন। ৫ জুন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রিফাত তার স্ত্রী মিন্নিকে নিয়ে ওই ক্যাফেতে এসেছিলেন। রিফাত তার বাইকটি চেয়ারম্যানের বাসার প্রধান ফটকের সামনে রেখে ওই ক্যাফেতে ঢোকেন। এর কিছুক্ষণ পর দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে লিসান এসে রিফাতকে বাইকটি অন্যত্র রাখার জন্য বলেন। কিন্ত রিফাত তা সরাতে সম্মত না হওয়ায় লিসান বাসার ভেতরে চলে যায়। একটু পরে সামসুন্নাহার খুকি এসে রিফাত শরীফকে বাইকটি অন্য কোথাও রাখতে বলেন।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাটিয়াল শপের ব্যবস্থাপক মো. আল আমিন বলেন, বাইক রাখা নিয়ে উভয়ের মধ্যে বেশ তর্ক হয় ও এক পর্যায়ে চেয়ারম্যানের স্ত্রী বাসার ভেতর চলে যান। রিফাতও স্ত্রীকে নিয়ে ক্যাফে ত্যাগ করেন। পরে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমাকে বাসায় ডেকে বলেন, তোমার দোকানে বাজে ছেলেদের আড্ডা হয়। তিনি দোকান ছেড়ে দিতে বলেন। এরপরই তারা ওই দোকান ছেড়ে বিপরীত দিকে অপর একটি দোকান ভাড়া নেন। আশপাশের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকজন এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
মাটিয়াল ক্যাফের মালিক মুশফিক আরিফ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসার প্রবেশদ্বারের একটি স্টল তাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম। সেখানে খাবারের দোকান করেছি। বাসার সামনে মোটরসাইকেল রাখাকে কেন্দ্র করে মাস দেড়েক আগে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার দোকান মালিকের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ওই ঘটনার পর তিনি আমাকে স্টল ছেড়ে দেয়ার জন্য দুই দিনের সময় সীমা বেধে দেন। তখনো ভাড়াটিয়া চুক্তির মেয়াদ দুই বছর ছিল। চেয়ারম্যানের চাপে আমি ঘটনার ১০-১২ দিন পর দোকান ছেড়ে দেই।
এ বিষয়ে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, রিফাত খুনের কয়েক দিন আগে আমার মেয়ে ও তার স্বামী মাটিয়াল ক্যাফেতে খেতে গিয়েছিল। তখন মোটরসাইকেল রাখা নিয়ে চেয়ারম্যানের স্ত্রীর সঙ্গে রিফাতের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ঘটনার পর মিন্নি আমাকে বিষয়টি বলেছিল। রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও ফুটেজে রিফাত-রিশানকে যে ভুমিকায় দেখা গেছে, তাতে মনে হচ্ছে সেই ঘটনার জের ধরেই আমার জামাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের শুক্রবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা হয়। দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি ব্যাক্তিগত কাজে বাসার বাইরে রয়েছি। স্ত্রী খুকির সঙ্গে রিফাতের বাগবিতাণ্ডার কথা অস্বীকার করেন তিনি। মাটিয়াল ক্যাফের মালিকের সঙ্গে ভাড়াটিয়া চুক্তি বাতিল প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, দোকানে উঠতি বয়সীদের আড্ডা বসে। তাতে এলাকার পরিবেশ খারাপ হচ্ছে। তাই হোটেল মালিককে স্টল থেকে নামিয়ে দিয়েছি।
শুক্রবার এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বাংলার আকবর হোসেন কথা বলেন দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী সামসুন্নাহারের সাথে। তিনি বলেন, কথা কাটাকাটি দূরের কথা তার সঙ্গে রিফাতের কখনো দেখাই হয়নি।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রমাণে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েই এ ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তদন্তাধীন মামলায় এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। ১৪ জন আসামি আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর বেশি আমরা কিছু বলতে পারছি না।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ২১,২০১৯)