দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: সেবা সংস্থাগুলোর নানামুখী তৎপরতার পরও জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীকে নিষ্কৃতি দেয়া গেল না। ফলে এই বর্ষায়ও নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী হয়েই রইল জলজট।

বিগত এক দশকে সেবা সংস্থাগুলো ঢাকার জলজট নিরসনে খাল, ড্রেনেজ, নর্দমা পরিষ্কার ও উন্নয়নের নামে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করে ফেলেছে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হয়নি ঢাকাবাসীকে। এই মেগাসিটির বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে পানি সরতে সময় লাগছে ৩ ঘণ্টা।

৫০ মিলিমিটার হলে ৪ ঘণ্টা। ৭০ মিলিমিটার হলে লাগবে অন্তত ১০ ঘণ্টা। ভরা বর্ষায় ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক বৃষ্টি হলেই ১০ ঘণ্টার জলাবদ্ধতায় আটকে থাকবে নগরী। সাম্প্রতিক সময়ে ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত না হলেও ঢাকার অনেক জায়গায় ২-১ ঘণ্টার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

স্বাধীনতার পর থেকে রাজধানীর খাল, নর্দমা, ড্রেন সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের নামে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ), ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ডিসি অফিস বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বা রুটিন ব্যয় হিসেবে বিপুল অর্থ খরচ করেছে, ব্যয়ের সঠিক হিসাবও নেই। তবুও জলজটের সুরাহা হচ্ছে না।

উপরন্তু নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।

এ নিয়ে কথা হয় প্রকৌশলী পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ হচ্ছে, পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক মাধ্যম বন্ধ করে কৃত্রিম প্রচেষ্টা চালানো। এখনও যতটুকু সম্ভব খাল ও ডোবানালাগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।

তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন বা ওয়াসার ড্রেনেজ ও খাল ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত কারিগরি লোক নেই। এজন্য তারা যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করছে, এতে কাক্সিক্ষত ফল আসছে না। এজন্য সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কাজ করতে হবে।

সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসা খাল, ড্রেন পরিষ্কার ও সংস্কারে ব্যয় করেছে প্রায় ৬৮৩ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) যৌথভাবে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ব্যয় প্রায় ১০৮ কোটি টাকা।

রুটিন কাজের অংশ হিসেবে এ বছর পানি নিষ্কাশন খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে ডিএনসিসি, ডিএসসিসি ও ঢাকা ওয়াসা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ঢাকা ওয়াসা অন্যবারের মতো সংস্কার কাজে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এছাড়া কয়েকটি সংস্থা নানা প্রকল্পের নামে এখনও বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গুলশান লেকের আধুনিকায়নে কাজ করছে রাজউক এবং কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের দু’পাশে ১০০ ফুট করে খাল খননের কাজ করছে সেনাবাহিনী। এতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

এর বাইরে ঢাকা ওয়াসার ৫ খাল খনন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৬০৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। তবে এসব প্রকল্প জলাবদ্ধতা নিরসনে কি ভূমিকা রাখবে তা পরিষ্কার নয় অনেকের কাছে। এখন বর্ষাকাল। কয়েক দফা বৃষ্টিও হয়েছে। এই মাঝারি বৃষ্টিতেও রাজধানীতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

এসব নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। কোনো সংস্থা বলছে, অন্যবারের তুলনায় জলাবদ্ধতা কম। কেউ বলছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় ঢাকায় জলাবদ্ধতা হবে, এটা মেনে নিতে হবে।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করতে হবে। এটা না হলে যে কোনো একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত জনবল এবং সক্ষমতা দিতে হবে।

একই সঙ্গে শহরের খাল, ডোবানালাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাধারগুলো রক্ষা ও উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

রাজধানীর খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের নামে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও রামচন্দ্রপুর খালসহ হাজারীবাগ খাল, বছিলা, বুড়িগঙ্গা শাখা, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি, বাড্ডা ও জিরানী খাল আবর্জনায় পূর্ণ। বাড্ডা খাল গত বছরও পরিষ্কার করা হয়েছিল।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা গেছে, সেটি আবর্জনায় ভরে গেছে। কিছুদিন আগে মিরপুর সাংবাদিক কলোনি খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। সম্প্রতি ওই খাল আবর্জনাপূর্ণ দেখা গেছে। গত বছর পরিষ্কার ও খনন করার পরও আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে, মহানগরীর রামচন্দ্রপুর, বছিলা, হাজারীবাগ, জিরানী ও সেগুনবাগিচা খাল।

সম্প্রতি খালগুলো পরিদর্শন করে করুণ চিত্র পাওয়া গেছে। ভারি বৃষ্টি হলে এসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না।

পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী বৃষ্টির পানি অপসারণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সাল থেকেই দায়িত্ব পালনে সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই এটা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার মূল দায়িত্ব থাকলেও এই সংস্থার নর্দমার পরিমাণ ৩৭০ কিলোমিটার।

এর বাইরে ১০ কিমি. বক্স কালভার্ট, ৮০ কিমি. খাল এবং ৪টি স্থায়ী পাম্প স্টেশন রয়েছে (কল্যাণপুর, ধোলাইখাল, রামপুরা, কমলাপুর)। এর বাইরে বর্ষায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৫টি পাম্প স্টেশন বসানো হয়। গোড়ান চটবাড়ীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি স্থায়ী পাম্প স্টেশন রয়েছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের পরিমাণ আড়াই হাজার কিমি.।

জলাবদ্ধতা নিরসনে বছরে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রম তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে ৫টি খাল পুনঃখনন প্রকল্প অনুমোদন হওয়ায় সেটা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জলাবদ্ধতা নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে ড্রেনেজের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চায় ঢাকা ওয়াসা।

২০১৪ সালের ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবকে বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালে পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইন কয়েকগুণ বেশি।

পরিচ্ছন্নতা কাজে দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। একটি সংস্থার কাছেই ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই ঢাকা ওয়াসার স্ট্রম ড্রেনেজ ব্যবস্থা সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা যায়।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকার বিদ্যমান বাস্তবতায় ৫০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে জলাবদ্ধতা হয় না। বেশি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয়। এবারও একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নগরবাসীকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।

ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বেশকিছু খাল পরিদর্শন করে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। ঢাকা ওয়াসা ও ডিএনসিসি ওইসব খালের আবর্জনা পরিষ্কার ও পানি নিষ্কাশনের বাধা অপসারণে কাজ শুরু করেছে।

শহরের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা একদিনে পরিবর্তন করা যাবে না, এটা আস্তে আস্তে সমাধান করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, ওয়াসার খাল সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এছাড়া একটি প্রকল্পের আওতায় ৫টি খাল উদ্ধারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, চলতি বর্ষায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমাতে ওয়াসা তৎপর। ৫০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত হলে তেমন জলাবদ্ধতা হচ্ছে না, তবে এর বেশি হলে জলাবদ্ধতা হবে। তবে আমরা সেটা তিন ঘণ্টার মধ্যে নিষ্কাশনের চেষ্টা করব।

এর বেশি ভারি বর্ষণ হলে, সেটার দুর্ভোগ নিরসন খুব কঠিন হবে। এছাড়া মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় এসব রোডে ভোগান্তি ভিন্ন মাত্রা পেতে পারে। তবে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জুলাই ২৩,২০১৯)