শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী: বছরজুড়েই ফেরিঘাটে ‘ভিআইপি-সেবা’ আতঙ্ক
মাদারীপুর প্রতিনিধি: এপ্রিলের শুরুর দিকের ঘটনা। শিমুলিয়া থেকে ফেরি পার হয়ে কাঁঠালবাড়ী আসবেন সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। উপর থেকে আসা মোবাইলে বার্তা আসার পর ঘাটে আয়োজন করা হয় বিশেষ ফেরির। কিন্তু ঘাটে ফেরি লাগিয়ে তাকে সেখানে উঠাতে খানিকটা দেরি করে ফেলেন সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পরদিন সকালে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআইডব্লিউটিসির সহকারী মহাব্যবস্থাপক বরকতউল্লাহ হেড অফিসে ক্লোজড হওয়ার চিঠি পান। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ওই দিনই তাকে চলে যেতে হয়। জানতে চাইলে বরকতউল্লাহ বলেন, ‘চিঠিতে কাজের স্বার্থে বদলির কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে তো আমার আর কিছু বলার নেই।’ তবে অবসরপ্রাপ্ত ওই সচিবকে ফেরি পার করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার পরদিনই বদলির চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
শুধু এ একটি ঘটনাই নয়, জোর করে ভিআইপি সুবিধা নেয়া ব্যক্তিদের কাছে এখন জিম্মি এ রুটে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতকারী ২১ জেলার কোটি মানুষ। এদের কারণেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে আটকে থেকে মারা যান তিতাসের মতো বহু মানুষ। এদের কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় অগণিত মানুষকে। বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও করার কিছুই থাকে না। ফলে ভিআইপি আতঙ্কে ভুগছেন ঘাটের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে যাত্রীরা। তাদের সার্ভিস দিতে না পারলে কপালে জুটে বদলি, ক্লোজ নয়তো সাসপেন্ড। তথাকথিত ‘ভিআইপি’ লোকদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার বহু নজির আছে পদ্মা পাড়ের এ ফেরি পয়েন্টে।
ভিআইপিদের সেবায় পান থেকে চুন খসলেই আতঙ্ক : ভিআইপির জন্য ফেরি ছাড়ার অপেক্ষায় টানা ৩ ঘণ্টা কাঁঠালবাড়ী ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে আটকে থেকে মারা যায় নড়াইলের কিশোর তিতাস। এটিই এই ঘাটের প্রথম ঘটনা নয়। আগেও এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে এই ঘাটে। তিতাসের পরিবার সচেতন বলে বিষয়টি উঠে আসে মিডিয়ায়। বছর দেড়েক আগে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মকবুল ব্যাপারীও (৬৭) একইভাবে এক ভিআইপির অপেক্ষায় আটকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান ফেরি ঘাটে।
শিমুলিয়া ফেরি ঘাটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব মৃত্যু কিংবা মুমূর্ষু মানুষের ঘাটে আটকে থাকার কান্না আমরা দেখি। যখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকে তখন অ্যাম্বুলেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করি। কিন্তু ভিআইপি থাকলে কিছুই করার থাকে না।’ ভিআইপি বা কথিত ভিআইপিদের পারাপারে কোনো বিচ্যুতি হলেই নেমে আসে বদলি, সাসপেন্ড কিংবা ক্লোজ হওয়ার মতো শাস্তি।
বছরখানেক আগের ঘটনা টেনে বিআইডব্লিউটিসির হেড অফিসের কর্মকর্তা বলেন, ‘খুলনা বিভাগের একজন ডিসির শ্যালিকা এবং ভায়রাসহ স্বজনরা যাচ্ছিলেন ঢাকায়। কাঁঠালবাড়ী থেকে ফেরিতে ওঠার পর ভিআইপি কক্ষ খুলে দেয়ার জন্য বলেন। কোনো নির্দেশনা না থাকায় কক্ষ খুলতে অস্বীকৃতি জানান ফেরির স্টাফ মো. মঞ্জু। ফলাফলে মঞ্জুকে বেদম মারধর করে ওই ডিসির স্বজনরা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা দেখা দেয় ঘাটে। সব ফেরি চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
খবর পেয়ে লৌহজং থানা পুলিশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছুটে আসেন। বহু কষ্টে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। কিন্তু ওই ঘটনার ৫-৭ দিনের মধ্যে বদলির আদেশ আসে মঞ্জু এবং মাস্টারের। জানতে চাইলে ভোলায় কর্মরত ওই মঞ্জু জানান, ‘অপরাধ করে মাফ চাওয়ার পরেও ওই ডিসি সাহেব আমাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ে। তখন তো চাকরি যায় যায় অবস্থা। পরে স্যারেরা দয়া করে বড় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু বদলি করে দেয়।’
বছরখানেক আগে তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিদেশ প্রবাসী ভাই কাচ্চু খান ফেরি পার হওয়ার জন্য আসেন শিমুলিয়া ঘাটে। আগেই মেসেজ দেয়া ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে ঘাটে আসায় কাচ্চু খানকে ফেরিতে ওঠাতে দেড়ি হওয়ায় সাসপেন্ড হন শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন সিকদার এবং স্টিমার ক্লার্ক শাহিন হোসেন। আড়াই মাস পর বহু ধরপাকড় করে চাকরি ফিরে পান।
জানতে চাইলে বর্তমানে কাঁঠালবাড়ী ঘাটে কর্মরত জসিমউদ্দিন সিকদার বলেন, ‘দায়িত্বে অবহেলার কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত করা হয় আমাদের দু’জনকে। তবে এটা ঠিক যে তৎকালীন নৌ-মন্ত্রীর ভাইকে নিয়ে যে রাতে জটিলতার সৃষ্টি হয় তার পরদিনই সাসপেন্ডের চিঠি পাই আমরা।’
ঘাটে সবাই ‘ভিআইপি’: ফেরিঘাটে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘সত্যিকারের ভিআইপিদের নিয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি এটা ঠিক। কিন্তু আরেকটি বড় সমস্যা হল এই ঘাটে ফেরি পারাপারের উদ্দেশ্যে যারা আসেন বিশেষ করে যারা একটু বিত্তশালী কিংবা রাজনৈতিক দলের তকমা আছে তারা সবাই এখানে এসে হয়ে যান ভিআইপি। দুটি ফেরি ঘাট সংলগ্ন জেলার ডিসি-এসপি-ওসিরাই নয় পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা পর্যন্ত হয়ে যান ভিআইপি।
তাদের জন্য ঘাটে ফেরি বেঁধে রাখতে হয়, ভিআইপি রুম খুলে দিতে হয়, ভিআইপি সার্ভিস তো আছেই। না হলেই গালাগাল, মারধর, নালিশ কিংবা লাঞ্ছনা। আর নালিশ মানেই বদলি, সাসপেন্ড বা ক্লোজড। শিমুলিয়া ঘাটের প্রান্তিক সহকারী আলমগীর হোসেনকে এরকম একটি নালিশের ঘটনায় পিরোজপুরের কাউখালিতে বদলি করা হয়েছিল।’
শিমুলিয়া ফেরি পয়েন্টের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ঘাট দিয়ে পার হয় বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ২১ জেলার কোটি কোটি মানুষ। এই ২১ জেলায় আছেন অর্ধশতাধিক এমপি। জেলা পর্যায়ে জজ ও সচিব পদমর্যাদার পান ভিআইপি প্রটোকল। এরপর রয়েছে এসব অঞ্চলের নাগরিক কিন্তু সচিবালয়ে কর্মরত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ ভিআইপি পদমর্যাদার বহু কর্মকর্তা।
ইদানীং একটা ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে যে এমপি-মন্ত্রীরাসহ ভিআইপি পদমর্যাদার সিংহভাগ কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার দেশের বাড়ি কিংবা নির্বাচনী এলাকায় যান এবং ঢাকায় ফেরেন শনিবার। এভাবে সব মিলিয়ে কয়েকশ’ ভিআইপি যদি নিয়মিত ফেরি পার হন এবং তাদেরকে ভিআইপি হিসেবে প্রটোকল দেয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য ঘাটে ফেরি বেঁধে রাখতে হয় তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা আর বলতে বাকি থাকে না।’
এক সময় এই ঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিসির একজন সহকারী মহাব্যবস্থাপক বলেন, ‘ঘাটে মোট ফেরি আছে ১৬-১৮টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বন্য্যাকালীন সময়ে তীব্র্র স্রোতের কারণে হাতে গোনা ৫-৬টি ফেরি চালানোর পাশাপাশি বন্ধ রাখতে হয় দুর্বল অবস্থায় থাকা বেশিরভাগ ফেরি। ওই সময়ে যদি ভিআইপিতে চাপ থাকে তাহলে বহু তিতাসের প্রাণ যাবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
কিছু কিছু ভিআইপির ক্ষেত্রে সমস্যা আরও প্রকট। অনেকে আবার পছন্দের ফেরির নাম জানিয়ে সেগুলোকেই ঘাটে রাখতে বলেন। তাদের কথা উপেক্ষা করার সাধ্য কার? এসব ক্ষেত্রে নিয়মিত যাত্রা বাতিল করে ৫-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সেই ফেরি ঘাটে বসিয়ে রাখতে হয়।
যা বললেন টিসির চেয়ারম্যান এবং ফেরি বিভাগের প্রধান : জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির ফেরি বিভাগের প্রধান আশিকুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা যে মিথ্যা সেটা বলব না। যাদের ক্ষমতা আছে তারাই এসব ঘটনা ঘটান। নিয়মানুযায়ী কেবল সরকারি সফরের ক্ষেত্রেই ভিআইপি প্রটোকল দিতে বাধ্য আমরা। তাছাড়া আইনানুযায়ী যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব, পুলিশের ডিআইজি থেকে তদূর্ধ্ব, আর্মির কর্নেল থেকে তদূর্ধ্ব এবং এমপি-মন্ত্রীরা ভিআইপি প্রটোকল পাবেন।
এখন যদি কোনো ব্যবসায়ী বা বড় কোনো নেতার আত্মীয় তাদের ক্ষমতার জোরে আমাদেরকে বদলি সাসপেন্ড কিংবা ক্লোজ করতে পারেন তাহলে আপনিই বলুন যে কেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদেরকে ভয় পাবে না? অমিও একমত যে এই জাতীয় ভিআইপিদের নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবেই আতঙ্কে থাকে ঘাটে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নিয়ামানুযায়ী সরকারি সফর প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট ভিআইপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দফতর থেকে তার সফরসূচি জানিয়ে চিঠি দেয়া হবে সংশ্লিষ্টদের। সেই সূচি অনুযায়ী সঠিক সময়ে তারা ঘাটে এসে পৌঁছলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। কোনো সরকারি চিঠি ছাড়াই হুট করে ঘাটে এসে নিজেকে ভিআইপি পরিচয় দেয়া কিংবা ঘাটে এসে পৌঁছানোর ৩-৪ ঘণ্টা আগে ফেরি রাখার নির্দেশ দিয়ে ঘাটে ফেরি আটকে রাখতে বাধ্য করা বন্ধ করা না গেলে এই সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছে যে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নন, সেটার বাস্তবায়ন হলে ফেরি ঘাটে আর কোনো জটিলতাই থাকবে না।’
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান প্রণয় কান্তি মজুমদার বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার পর ফেরি ঘাটের ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনছি আমরা। ফেরি ঘাটে কর্মরতদের বিশেষ পোশাক দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যাতে কে বিআইডব্লিউসিটির আর কে সাধারণ মানুষ তা বোঝা যায়। তাছাড়া জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে যাতে ঘাটে দায়িত্বরতদের সাথে যে কেউ যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য প্রতিটি ঘাট পয়েন্টে যোগাযোগের মোবাইল নম্বরসহ বসানো হচ্ছে বোর্ড।’
ফেরিঘাটে ভিআইপি জটিলতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টিও দেখছি আমরা। কোনো বিশেষ ব্যক্তির কারণে সাধারণ মানুষের যাতে দুর্ভোগ না হয় সে জন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আশা করি ভবিষ্যতে এরকম দুঃখজনক ঘটনা আর ঘটবে না।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ৩, ২০১৯)