ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-সাত
সন্ধ্যা নামায় রাখি
রোকেয়া আশা
(পূর্ব প্রকাশের পর) রাতের বেলা খেতে বসে নাজিমের আব্বার মন ভালো হয়ে গেলো। মূলত দুটো কারণে।
এক, নাজিম এখন সুমাকে নমা বলে ডাকছে।
দুই, কলার থোড় দিয়ে কুচো চিংড়ির ভাজিটা খেতে খুব স্বাদের হয়েছে। সুমা মেয়েটার বয়স কম হলেও রান্নার হাত ভালো, বেশ ভালো। এই ধুমসি মেয়েটাকে বিয়ে করা তাহলে এতটাও ভুল হয়নি নাজিমের আব্বার। অবশ্য এসবের মধ্যেও তার মনটা খচখচ করতে থাকে। সকালের ঘটনার জন্য। সকালবেলায় সুমা যেই কাজটা করেছে তারপরেও যদি নাজিমের আব্বা কিছু না করে তাহলে পাড়া পড়শিরা সারাজীবন তাকে ক্লীব ভেবে যাবে। কিছু একটা তো করতেই হবে ; কিন্তু কি করা যায় সেটা ভেবে পাচ্ছে না লোকটি।
" নমা, একটু ডাইল দেও। "
নাজিমের গলা শুনে সামনে তাকায় নাজিমের আব্বা। সাধারণত রাতে এরকম সময়ে লোডশেডিং থাকে বেশি। আজ বিদ্যুৎ আছে। হলুদ আলোয় সুমাকে আরও কালো দেখাচ্ছে। পুত্রের মুখের দিকে একবার তাকায় নাজিমের আব্বা। অত্যন্ত সুশ্রী এই শিশুটি। মায়ের মত রুপ পেয়েছে নাজিম আর আফসানা দুই ভাইবোনই। আফসানার কথা মনে আসতেই কোত্থেকে একটা পিতৃসুলভ দূর্বলতা চলে আসে তার মনে। মেয়েটার কোন খোঁজখবর নেয়া হয়নি এরমধ্যে। কাল কি একবার যাবেন দেখতে?
পরমুহূর্তেই জোর করে মাথা থেকে ভাবনাটা সরিয়ে দেয়, ধানের সময় হয়ে আসছে। প্রচুর কাজ এইদিকে। তারওপর মজুরও তেমন পাওয়া যায় না আজকাল। যারা আছে, তাদের আবার দুপুরে খাওয়াতে হয়, দিনচুক্তিতে টাকাও দিতে হয়। আরে বাবা, টাকা নিচ্ছিস নে। সাথে আবার ভরপেট খাওয়াতে কেন হবে?
মজুরের কথা ভাবতেই নাজিমের আব্বার মাথায় সুমাকে টাইটে রাখার জন্য একটা ভালো বুদ্ধি চলে আসে। এবার ক্ষেতের কাজের সময় আর কোন মহিলাকে ডাকা হবে না। মজুরদের রান্নাবান্না সব সুমা একাই করবে। খুব তেল না মাগীর? এবার কাজকর্ম করে এই তেল কমাক। দেখুক, বুঝুক, কেমন লাগে।
" নাজিমের আম্মা! "
সুমা প্রথমে বুঝতে পারে না লোকটা কাকে ডাকছে। তবে প্রায় সাথে সাথেই সামলে নেয় সে। তাকেই ডাকছে। নাজিমের আম্মা তো মরেই গেছে। এখন পুরো দুনিয়ার কাছে সেই নাজিমের মা।
" জ্বি? " সুমা ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়।
" ভিতরবাড়ির উঠানে দুইটা বড় দেইখা চুলা বানায়া ফেলবা কালকেই। "
সুমা প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারে না। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
" কি হইলো? কথা বুঝো নাই? " এবার লোকটা ধমকে ওঠে। আড়চোখে সুমা দেখে নাজিম কেঁপে উঠেছে, নিঃশব্দে।
" জ্বি। বানায়া ফেলবো। " সুমা দোনোমোনো করতে করতে শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করেই ফেলে,
" কিন্তু চুলা বানায়া কি হবে? আমাদের তো পাকঘরে চুলা আছেই। "
সুমা ভেবেছিলো লোকটা এখনই ফোস করে উঠবে। কিন্তু তা না করে লোকটা ধীরেধীরে বলতে থাকে,
" ধানের মৌসুম। আমাগো তো আল্লায় দিলে জমিজমা ভালাই। এহন এতগুলা ক্ষেতের ধান তো আর আমি কাটতে পারি না। পারি? "
সুমা নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়। লোকটা আবার বলতে থাকে,
" তারমানে ধান কাটার জইন্য, সেই ধান মাড়াই করার জইন্য আমার মজুর ভাড়া করা লাগবো। তাগোরে মজুরি যেমন দেওয়া লাগবো, তেমন রোজ দুপুরে পেট ভইরা ভাতও খাওয়ানো লাগবো। পাকঘরের চুলায় কি তুমি বড় ডেগে রানতে পারবা? "
সুমা ঘাড়ের এপাশ ওপাশ করে মাথা নাড়ে। বোঝায় পাকঘরের চুলায় আসলেই অনেক মানুষের রান্না করা যাবে না।
.
ফাতেমা বেগম খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, তার খুব আলস্য চলে আসছে সব কাজেই। কাজ করতে গেলেই মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে দিয়ে একটু সাহায্য নিতে। ইসরাত না, আফসানা।
সমস্যা হচ্ছে, আফসানার সাথে সদ্যই একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। আপাতত কিছুদিন ওকে দিয়ে কাজকর্ম করানো যাবে না। টিমটিমে কুপিবাতির আলোয় ভাতে সেক দিতে দিতে ফাতেমা বেগম যখন আফসানার কথা ভাবছিলেন, তখনই জালাল উদ্দীন রান্নাঘরে ঢুকলেন।
" ইসরাতের মা? "
ফাতেমা বেগম চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকান।
" কিছু কইবেন? "
জালাল উদ্দীন ইতস্তত বোধ করেন। তারপর আস্তে করে শুধু বলেন,
" মাইয়াডার মা নাই। একটু খেয়াল রাইখো ওর দিকে। "
কথাটা শেষ করেই তিনি বের হয়ে যান। ফাতেমা বেগম সংশয়ে পড়ে যায় আবারও। এতসব কুটিলতা তার মধ্যেই বা কোত্থেকে আসছে? নাকে হাল্কা পোড়া গন্ধটা যেতেই সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি। ভাতের পাতিলটা দুটো ন্যাকড়া দিয়ে চেপে ধরে উঠে পড়েন। ঘর থেকে দুটো বালিকা কণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আফসানা এইবাড়িতে আসার পর থেকে ইসরাতকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কমেছে। বড্ড ডানপিটে মেয়েটা। একদণ্ড স্থির থাকে না, বাড়িতে রাত না হলে দেখাই পাওয়া যেতো না। আফসানা আসায় তার ঘরের দিকে একটু অবশ্য মন বসেছে।
ফাতেমা বেগম ভাবেন অন্য কথা। আজকের দিনটা গেলো। আজও কোন রক্তপাত হয় নি। ইসরাতের আব্বাকে কি বলবেন? নাকি আরও দুটো দিন অপেক্ষা করে তারপর বলবেন? (ক্রমশ)
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ০৪,২০১৯)