শাবিপ্রবির সেই ইয়াবা সেবক ছাত্রলীগের সহ সভাপতি এখনও আবাসিক হলে
সিলেট প্রতিনিধি: ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তরিকুল ইসলামের ইয়াবা সেবনের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সমালোচনার ঝড় উঠে ক্যাম্পাসে।
ছবি ভাইরাল হওয়ার আগে তরিকুল নগরীর খুলিয়াপাড়া, আখালিয়া এলাকার এলাহী ৯/এ নং বাসায় বসবাস করতেন। পরে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান থেকে রেহাই পেতে ওই বাসা ত্যাগ করে আত্মগোপনে থাকেন বেশ কিছু দিন।
কিন্তু ‘ইয়াবা তারেক’ খ্যাত তরিকুল প্রক্টর জহীর উদ্দিনসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সুম্পর্কের সুযোগে বিগত কয়েক মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলে অবস্থান করছেন। অথচ ছবি ভাইরাল হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আশ্বাস দিলেও এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তার বিরুদ্ধে।
ছাত্রলীগ নেতা তরিকুলের ইয়াবা সেবনের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর শাবিপ্রবির ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘মাদকসেবন ও মাদক ব্যবসায় জিরো টলারেন্সে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে, প্রমাণ পাওয়া গেলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।’
ভিসির এমন আশ্বাসের পরও প্রশাসন তো কোন ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো সরকারের মাদক বিরোধী অভিযানের ফাঁদে পড়তে যাওয়া তারেককে আবাসিক হলে পুণর্বাসন করেছে।
এ বিষয়ে শাবিপ্রবির ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস, ইভটিজিং ও মাদকের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জিরো টলারেন্সে রয়েছে। অনেক সমস্যা ছিল, অধিকাংশই সমাধান করা হয়েছে। বাকিগুলোও হবে, তবে একটু সময় লাগবে। ২৮ বছরের জঞ্জাল তো আর বললেই শেষ হবেনা।
একপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগনের টাকা যেন সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয় সেটাই আমরা চাই। এখানে কারো ভাগ বসানোর সুযোগ নেই।
এদিকে আবাসিক হলে অবস্থান করে তরিকুল এখনো আগের মত মাদকের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। শাহপরান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে থেকে তিনি ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গেও নিয়মিত বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন তিনি।
প্রক্টরের সঙ্গে সুসম্পর্ক
পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী তরিকুলের শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে অন্তত পাঁচ বছর আগে। ইয়াবা সেবক অছাত্র তরিকুল আবাসিক হলে অবস্থান করলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে হলে পুনর্বাসন করে প্রশাসনের একটি অংশ। অনেক ছাত্রলীগ নেতার অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে তার খুব সখ্যতা থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেউ।
বিভিন্ন সময়ে প্রক্টরের গাড়িতে চলাচলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইস্যুতে প্রক্টরের সঙ্গে বৈঠকও করতে দেখা গেছে তারেককে। এমনকি আবাসিক হলে কে অবস্থান করবে না করবে এসব বিষয় ইতিপূর্বে প্রক্টর নিয়ন্ত্রণ করায় তরিকুলের হলে অবস্থান করা সহজতর হয়েছে বলে অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাদের। অবশ্য প্রক্টরের কথায়ও এসবের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমদ উল্টো প্রশ্ন করেন- হঠাৎ তরিকুলকে নিয়ে কেন বলছেন, বললে তো অনেক কিছু নিয়েই বলার কথা। আপনাদের কাছে তো অনেক ইনফরশেন আছে মাদকের। তিনি বলেন, ১২শ’ কোটি টাকা নিয়ে তো গত একসপ্তাহ ঘুমাতে পারিনি। এই সপ্তাহ আমার ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরণের অস্থিরতার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় শহর কেন্দ্রীক নেতাদেরও যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রক্টর বলেন, এটা তদন্তের বিষয়। একটা ছবি দেখেই তো আর কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। আমার ক্যাম্পাসে অনেক ছাত্র আছে যারা এখানকার ছাত্র নয়। শুধু তরিকুল নয়, ছাত্রলীগের সবার সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। আপনি আদৌ রিপোর্টার কী-না জানি না। রিপোর্টার হয়ে থাকলে সামনে গিয়ে কথা বলার অনুরোধ করেন তিনি।
নজর ১২শ’ কোটি টাকার ওপর
অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প পর্যায় ১ ও ২ এর প্রায় ১২০০ কোটি টাকায় ভাগ বসাতে এখনো ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন তারেক। বিশেষ করে তরিকুলের অনুসারি কয়েকজনকে ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকার প্রকল্পে ভাগ বসানোর পরিকল্পনা করছেন তরিকুল বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন অনুসারী হয়ে যেখানে অন্য নেতারা নিজে চলতে পারেন না; সেখানে তরিকুল সিলেট শহরে ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করতেন, দামি দামি মোটর বাইক চালাতেন। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে তিনি অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন বলে অভিযোগ করেন সাবেক এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা। এছাড়া তরিকুলের বিরুদ্ধে ছাত্রদল-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে।
নিজ কর্মীকে গুলি
তারেকের বিরুদ্ধে নিজ কর্মীকে গুলি করারও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এক সংঘর্ষে তারেকের ছোড়া গুলি তার নিজেরই এক কর্মীর পায়ে লাগলে গুরুতর আহত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের সঙ্গে তরিকুলের ঘনিষ্ঠ সখ্যতা থাকায় তরিকুল বেঁচে যান।
উল্টো গুলির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ১৪ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করেন সোহাগ-জাকির। ওই সময়ে বহিস্কৃত ১৪ জনই এসএম জাকির হোসাইনের একান্ত আস্থাভাজন তরিকুলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল।
কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
নির্বাচনের আগ মুহূর্তে ইয়াবা সেবনের ছবি ভাইরাল হয়ে পড়লে তাতে ব্যাপক ব্যাকফুটে চলে যায় ছাত্রলীগ। সেসময় শাবি ক্যাম্পাস, সিলেটসহ সারাদেশের জামায়াত-বিএনপি’র নেতারা সেই ছবি শেয়ার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। অবস্থা সামাল দিতে তখন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেছিলেন, তারেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে নয় মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলছে। তরিকুল তো তখনই বহিস্কার হওয়ার কথা। আমি আজই ইউনিটের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য বলছি। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তরিকুল ইসলাম বলেন, দুই আড়াই বছর আগের ইয়াবা সেবনের একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। আমি র্দীঘদিন ধরে এসবের সঙ্গে নেই। ক্যাম্পাসে আগে যেমন ছিলাম, এখনো তেমনি আছি। তিনি দাবি করেন, একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব রটাচ্ছে।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ০৪, ২০১৯)