তৌহিদুল ইসলাম, দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশের শিল্পায়নে শেয়ারবাজারের অবদান কোনোভাবেই বাড়ছে না। বরং দিন দিন তা কমছে। এর বিপরীতে বেড়েই চলেছে ব্যাংক ঋণ নির্ভর অর্থায়ন। যা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে ও শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতে ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে শিল্পায়নের প্রসারে যেখানে শেয়ারবাজার থেকে যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং প্রায় ৫০ শতাংশ অর্থের যোগান দেয়া হয়, বাংলাদেশে সেখানে এ হার মাত্র ১ শতাংশ। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও আইনগত জটিলতার বিপরীতে ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য ও বিভিন্ন কারণে সুবিধাজনক হওয়ায় যোজন যোজন পিছিয়ে আছে শেয়ারবাজ

বাংলাদেশে শেয়ারবাজার থেকে আইপিও’র মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ এবং ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের তুলনামুলক হার বেশ হতাশাব্যঞ্জক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বেসরকারি শিল্পখাতে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে সম্মিলিতভাবে অর্থের যোগান ছিলো ৪৫ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণ বাবদ অর্থের যোগান ছিলো ৪৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা মোট যোগানের ৯৮ শতাংশ। এর বিপরীতে শেয়ারবাজার থেকে অর্থের যোগান ছিলো মাত্র ৯১৮ কোটি টাকা, যা মোট যোগানের ২ শতাংশ। ২০০৯ সালের পরবর্তী চার বছর শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের হার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমশ এই হার কমে যায়। এরও পরে ২০১৭ সালে বেসরকারি শিল্পখাতে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে সম্মিলিতভাবে অর্থের যোগান দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিলো ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা মোট যোগানের ৯৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যদিকে পুঁজিবাজার থেকে সরবরাহকৃত অর্থের পরিমাণ ছিলো ১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা, যা মোট অর্থায়নের মাত্র দশমিক ৯ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলতে হলে একটি কোম্পানিকে নানা নিয়ম মেনে আইপিও অনুমোদনের জন্য বিএসইসি বরাবর আবেদন করতে হয়। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে লটারীর মাধ্যমে চাঁদা সংগ্রহের সুযোগ মেলে। এভাবে টাকা সংগ্রহ করতে যে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়, এতে করে অনেক কোম্পানিই শেয়ারবাজারে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের শিল্পায়নে শেয়ারবাজারের পিছিয়ে থাকার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের জন্য সময় সময় ক্ষেপন ও আইনী জটিলতা দায়ী। যে ধরনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে, তাতে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হন। এছাড়া ব্যাংকের থেকে টাকা ঋণ নিতে কর্পোরেট গর্ভনেন্স জরুরি নয়। কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিতে কর্পোরেট গর্ভনেন্স দরকার, যা অনেক কোম্পানিই পরিপালনে আগ্রহী থাকে না। আর উদ্যেক্তারা সাধারণত চলমান কোম্পানির জন্য ব্যাংক ঋণ নেন। পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করতে হলে যে সময় প্রয়োজন, তাতে কোম্পানির কার্যক্রম দীর্ঘ সময় আটকে থাকে। সেকারণে ঋণের চড়া সুদ পরিশোধের বিষয়টি একজন উদ্যেক্তার কাছে প্রধান বিষয় হয়ে দেখা দেয় না। তাদের কাছে সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ গ্রহণ করেন শিল্পোদ্যাক্তারা। এছাড়া ঋণ খেলাপীরা পার পেয়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহের ঝোঁক বেশী। তবে ব্যাংক ঋণে চড়া সুদ যেমন দেয়া লাগে, তেমনি আবার পুঁজিবাজারে কোম্পানিটিকে ডিভিডেন্ড দিতে হয়।’

তবে ব্যবসায়ীদের মতে, ব্যাংক ঋণ সহজলভ্য ও এতে নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও ব্যাংকের চড়া সুদ শিল্পায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। বছর না ঘুরতেই কোম্পানিকে সুদসহ আসল পরিশোধ করতে হয়। মুনাফা তোলার আগেই চাপে পড়ে যায় কোম্পানিগুলো। এভাবে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে শিল্পখাতে ব্যাংক ঋণ নির্ভর অর্থায়নের কারণে সুদের হারের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের সুযোগ সহজ হলে ব্যাংকের সুদের হার কমতে পারতো বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

Bank Financing VS Financing Through Capital Market

Year Bank loan

Financing through

Capital Market

Total Percentage
2009 44700 918 45618 2.0%
2010 83800 3390 87190 3.9%
2011 71700 3234 74934 4.3%
2012 76800 1843 78643 2.3%
2013 43700 911 44611 2.0%
2014

86300

3264 89564 3.6%
2015 101800 676 102476 0.7%
2016 118700 950 119650

0.8%

2017 167300 1442 168742 0.9%
Source: Bangladesh Bank and Bangladesh Securities and Exchange Commission

কোম্পানির তালিকাভুক্তি স্থগিত কি কোনো সমাধান ?

শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের আইনী দীর্ঘ প্রক্রিয়ার জন্য শিল্পোদ্যাক্তারা এমনিতে হতাশ। একই সঙ্গে তালিকাভুক্তির পর সেকেন্ডারী মার্কেটে কোম্পানির শেয়ারের দরপতন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও নিরাশ করেছে। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যেই বাজারের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, যা শেয়ারবাজারের দরপতন তরান্বিত ও দীর্ঘায়িত করে তুলেছে।

তালিকাভুক্তির পর বেশ বাংলাদেশের কয়েকটা কোম্পানির শেয়ারের দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। গত ৭ বছরে বাংলাদেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ৮৭টি কম্পোনির মধ্যে ১০টির শেয়ারমূল্য ফেসভ্যালুর নিচে চলে গেছে। এসব কোম্পানি ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বিএসইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিশ্বের সব শেয়ারবাজারেই এভাবে শেয়ারের দর ইস্যুমূল্যের ওপর নিচে ওঠানামা করে থাকে। তবে সে সব দেশে একারণে সেসব দেশের শেয়ারবাজারে কম্পানির তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে না।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে ২০১৮ সালে তালিকাভুক্ত ৫৮টি কম্পানির মধ্যে ২১টি বা ৩৬ শতাংশের শেয়ারদর তালিকাভুক্তির দিন থেকে ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। ২০১৭ সালে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় ৮৮ কম্পানি। এর মধ্যে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে প্রথম লেনদেন দিবসে দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে ২০টি কম্পানির বা ২৩ শতাংশের।

হংকং এ ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৬০টি তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮০টির দরই ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। এভাবে পাকিস্তান, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর মায়নমার সহ আশপাশের দেশগুলোতে শেয়ার ইসুর পরপর দরপড়ে গেলেও্ সেজন্য তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করেনি।

কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কারণে শেয়ার বাজারের ধারাবাহিক দরপতন হলেই কোম্পানির তালিকাভুক্তি আটকে রাখা হয় ।আবার কিছুদিন পর নতুন আইন করে নুতন করে সুযোগ দেয়া হয। তবে বার বার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বদলে ফেলার খুব বেশী সুফল মেলে না বাজারে।

ইস্যু ম্যানেজার তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন করা কোম্পানির অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করে আর্থিক ও সরেজমিন প্রতিবেদন বিএসইসির কাছে জমা দেয়। তা যাচাই বাছাই করে বিএসইসি অনুমোদন দেয়। এ বিষয়ে একটা ভুল তথ্য প্রচরিত রয়েছে। সেটা হলো লেনদেন শুরু পরবর্তী কোম্পানি আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি হলে এর দায় দায়িত্ব ইস্যু ম্যানেজারের। অথচ আইন রয়েছে ইস্যু ম্যানেজোরের দায় শেষ হয়ে যায় লেনদেন শুরুর পরপরই। তালিকাভুক্তি ও লেনদেন শুরুর পর কোনো কারণে কম্পানির পরিস্থিতি খারাপ হলে তা দেখার দায়িত্ব বিএসইসি ও ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কর্পোরেট ফাইন্যান্স বিভাগের।

এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ খুব বেশী দেখা যায়নি। তবে শেয়ারবাজারে দরপতন দীর্ঘ হলে এক অলিখিত নিয়মের আওতায় শেয়ারবাজারে সব ধরনের কোম্পানির তালিকাভুক্তি স্থগিত রাখে বিএসইসি।

২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে বিএসইসির দেওয়া এক নিদের্শনায় দেখা গেছে, ৫ শতাংশ শেয়ারধারী উদ্যোক্তাদের শেয়ারের লক ইনের মেয়াদ তিন বছর ধার্য করা হয়েছে।

গত বছর(২০১৮ সালের ১২ মার্চ) জারিকৃত এক আদেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে প্রি-আইপিও শেয়ারের লক-ইন রাখার মেয়াদ ২ বছর করা হয়।যা প্রসপেক্টাস অনুমোদনের দিন থেকে কার্য্কর বলে জানায় বিএসইসি। আবার গত ২০ জুন আরেক আদেশে লক-ইনের মেয়াদ তালিকাভুক্তির দিন থেকে কার্য্কর হবে বলে নির্দেশনা দেয় বিএসইসি।

পৃথিবীর সব দেশেই এ ধরনের শেয়ারের লক-ইনের মেয়াদ ৩ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের লক-ইন পিরিয়ড ১২ মাস। পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে ১২ মাস, চায়না স্টক এক্সচেঞ্জে ১২ মাস। থাইল্যান্ডে ১২ মাস মালয়েশিয়ায় ৬ মাস, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ মাস, হংকং ৬ মাস, মায়ানমার তিন মাস, সিঙ্গাপুর ৬ থেকে ১২ মাস পর্য্ন্ত লক ইন পিরিয়ড ধায্র্ করা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশের সিকিউটিরিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, লক-ইনের মেয়াদ বাড়িয়ে পুজিঁ সংগ্রহের পথ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। কেননা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের টাকা একটা কোম্পানিতে আটকে থাকলে নতুন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার সুযোগ কমে যায়।

আবার ইস্যু মূল্যের নিচে দর কমে যাচ্ছে বলে বাজারে নতুন কম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা যাবে না এটা সমাধান নয়। এটা করা হলে বিষয়টি হবে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সমান ঘটনা। বরং প্রকৃত ভলো মৌল ভিত্তির শেয়ার বাজারে আনার জন্য ইস্যু ব্যবস্থাপকদের যেমন উৎসাহ দিতে হবে তেমনি দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিতে হবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারবাজার থেকে যদি শিল্পায়নের জন্য টাকার যোগান দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা হতো, তবে বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেতো। ব্যাংকের বদলে শিল্পোদ্যাক্তারা শেয়ারবাজারের দিকে ঝুঁকতেন বেশী। শিল্পখাতে দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের জন্য শেয়ারবাজারের বিকল্প নেই।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ০৬,২০১৯)