পাভেল চৌধুরী

আকাশে আকাশে আলো আঁধারির খেলা

নিয়নের আলোয় পার্টি অফিসের বাইরেটা যত ঝলমলই মনে হোক না কেন ভেতরের চিত্রটা কিন্তু অন্যরকম। বড় কোনো নেতা না আসলে, নিদেনপক্ষে জেলা কমিটির সভাপতি বা সম্পাদক, বা তেমন কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে, পার্টি অফিস ফাঁকাই থেকে যায়।

নীচের বড় হল ঘরে কটা ‘চ্যাংড়া’, সন্ধ্যেয় যাদের যাওয়ার তেমন কোনো জায়গা বা কাজ থাকে না, পার্টির ক্যাডার হিসেবে যাদের পরিচিতি, দোকানে বরাদ্দ ফ্রি লাল চা খায় আর পকেটের পয়সায় ভাগাভাগি করে সিগরেট ফোঁকে। রাজনীতির আলোচনা তেমন একটা হয় না, আলোচনায় কি হয়? তারা বোঝে এ্যাকশান, কাজ। নেতার নির্দেশ। নির্দেশ পেলে দ্বিধাহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে মুহূর্তকাল দেরী করে না। উপরে সভাপতি আর সম্পাদকের ঘর অধিকাংশ সময় ফাঁকাই থাকে। সেখানে অবশ্য মাঝে মধ্যে এসে বসে জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ জাকারিয়া। তিনি যে দলীয় কাজে আসেন এমন না, আবার বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা জমাতে আসেন তাও না। তিনি আসেন, চুপচাপ বসে থাকেন, দু-এক কাপ চা খান আর চেয়ারে হেলান দিয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে সিগরেট টানেন। মোঃ জাকারিয়াকে যারা জানে তারা তাঁকে একটু ভিন্ন চোখে দেখে, কিছু বাড়তি সম্ভ্রমও তিনি পেয়ে থাকেন।

মোঃ জাকারিয়ার বয়স ত্রিশের কোঠায়। ক’বছর হলো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন। চেহারা স্বাস্থ্য সুদর্শন, সুপুরুষ। বিশ্ববিদ্যালয় চত্ব¡রে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে ছিলেন খুবই সফল। তাঁর দীপ্ত পদচারণা ছাত্র-শিক্ষক সকলের দৃষ্টি কেড়েছিল। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলো তারপরেই। ফলিত রসায়নে মাস্টার্স শেষ করার পর নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে কাজে লাগাতে যেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। নিজের ব্যক্তিগত উন্নতির সাথে মেহনতি মানুষের উন্নতিকে এক করে ফেললেন। এ হচ্ছে নতুন ভাবে রাজনীতিকে দেখা। বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে থেকেই মেহনতি মানুষের রজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দুম্ করে তিনি পাওয়ার পার্টিতে যোগ দিয়ে ফেললেন এবং ছিনিয়ে নিলেন সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। বড় দল, দাম তাঁর বেশি, প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝলেন বিধি বাম। যথাসাধ্য চেষ্টা করেও পছন্দ মত এমপি ক্যানডিটেট বানানো গেল না। ঢাকা থেকে নমিনেশন পেপার পকেটে করে প্লেন থেকে নামলেন এক দুঁদে ব্যবসায়ী, তাঁর গলায় মালা পরাবার পাল্লায় জাকারিয়া পিছিয়ে পড়লো। কিন্তু ভদ্রলোক বুদ্ধিমান, জাকারিয়ার ঘাড়ে থাবা বসিয়ে বললেন, —ইয়ংম্যান, আমি পলিটিক্স বুঝিনে, তোমাদের মত শিক্ষিতও না, পলিটিক্স তোমরা করবা, আমি ইনসেনটিভ জোগাবো; টাকা দেব।

নির্বাচনে টাকা তিনি যথেষ্ট দিলেন তারপর জিতে যেয়েই বুঝিয়ে দিলেন পলিটিক্সও তিনি কম বোঝেন না।

দলের নতুন কমিটিতে সভাপতি হলো এলাকার বিখ্যাত চোরাকারবারি চোরাকামাল, আর সম্পাদক ল্যাংড়া রশিদ। ল্যাংড়া রশিদ সন্ত্রাসী। বেশ কিছুদিন আগে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গরু চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়লে এলাকার মানুষ গণপিটুনিতে তার পা ভেঙেছে, সেই থেকে নামের এই উপাধি। এই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো: জাকারিয়া স্বপদেই বহাল থাকলেন। এমপি মহোদয় তাঁকে বিশেষ ¯েœহ করেন। সান্ত¦না দেন এই বলে, ইয়াংম্যান, তোমার মধ্যে ইমোশন বেশী, আরও ম্যাচিওরড হতে হবে।

জাকরিয়া তাতে সান্ত¦না পায় না বরং মনের প্রত্যয়টাই যেন ঝংকার দিয়ে ওঠে,— দেখা যাক্।

এমপি’র সাথে সভা সমিতিতে জাকারিয়া বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। সে বলে ভালো, মানুষ অভিভূত হয়ে শোনে, এমপি মহোদয় ভাল বলতে পারেন না। গলায় তাঁর টান নেই, সুর নেই। গলা একটু উঁচুতে তুললেই শব্দ চোক্ করে যায়, সে কারণেও এমপি’র কাছে জাকারিয়ার কদর বেশি। এলাকার মানুষ এমপিকে চেনে কিন্তু তারা নেতা মানে জাকারিয়াকে।

জাকারিয়া জানে তার কতটুকু ক্ষমতা। আসলে সবক্ষমতাই এমপি’র। তারপরেই আছে জেলা কমিটির সভাপতি চোরাকামাল আর সম্পাদক ল্যাংড়া রশিদ।

তারপরও ভাই ভাই করে এমপি মহোদয়ের পা’য় পা’য় ঘোরার মধ্যেই যে তাঁর বর্তমান অবস্থান, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, এটুকু জাকারিয়া বোঝে এবং নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এই কাজেই সে আত্মনিয়োগ করে। তাতেই কি সে এমপি’র মনের নাগাল পায়? চোরাকামাল আর ল্যাংড়া রশিদই যেন সেখানকার সবটুকু দখল করে রাখে।

একদিন ঘনিষ্ট মুহূর্তে এমপি মহোদয় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,— তুমি ভার্সিটিতে এত ভাল বিষয়ে লেখাপড়া করে এই রাজনীতিতে কেন এলে?— সে উত্তর দিতে পারেনি।

সে কেন এল? এখনভাবে, শুধু কি নিজের আখের গোছাতে? আসলে তাঁর মনে হয়েছিল আইডিয়া যদি থাকে পাওয়ার পর্টির মধ্যে থেকেও সমাজের জন্য ভাল কিছু করা যাবে না, তা কেন হবে? চাইকি মেহনতি মানুষের রাজনীতিতেও কী পরোক্ষ সহযোগিতা করা যায় না?

হাতের মুঠোয় নিবিড় অন্ধকার

সিজার পটকা শিমুল মদন আরও দু’জন নাম না জানা ছেলে তখন পার্টি অফিসের নীচের তলায় আড্ডা জমিয়েছে। প্রতিদিন এ সময় তাদের আড্ডা বেশ জমাট হয়ে ওঠে। পার্টি অফিস ফাঁকা, তেমন কারো আসারও সম্ভাবনা থাকে না, কাজেই নিবিড় আড্ডা হতে অসুবিধে নেই। সিজার দলের ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি। কোনো এক সময়ে কোনো এক কলেজে সে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ছিল। ছাত্রত্বের পরিচয় তার সেইটুকু; তাতে অবশ্য যে কোনো কলেজের সিনিয়র ছাত্রদের ভাই হয়ে উঠতে তার সমস্যা হয় না। দলের নেতাদের ও খুব বাধ্য; গুছিয়ে কথা বলতে পারে এবং সাহসী। ওদের সবারই বয়স ২০/২৫ এর কোঠায়। যৌবনের জ্যোতি সর্বাঙ্গেই প্রজ্জ্বলিত। পটকা একটু ঢ্যাঙ্গা ধরনের। পরণের পাঞ্জাবী কাঁধ বরাবর সটান ঝুলে আছে। তার দুই পাশ পকেটে যে ভারী কিছু আছে দেখে বোঝা যায়। সে দাঁড়িয়ে আছে। সারা মুখে হালকা হাসি ছাড়িয়ে উৎসুক চোখে সে তাকিয়ে আছে সিজারের দিকে।

সিজার বসে আছে হাতওয়ালা চেয়ারে, টেবিলের এক পাশে। সামনে টেবিল ঘিরে বসেছে বাকী সবাই।

কি রে, হা করে দাঁড়িয়ে আছিস? সিজার বললো।

না, পার্টি আফিস তো! ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলে পড়লো পটকার।

পার্টি আফিস তো কি? সিজার অধৈর্য্য হয়। পার্টির নেতাদের আমরা চিনিনে? ধোয়া তুলসির পাতা? সব শালাকে চিনি, নে বের কর। আমরা হচ্ছি ফ্রাসট্রেটেড জেনারেশন, বুঝলি? অতো বাছবিচার নেই।

পটকা তবু দ্বিধা করে। তখন সিজার চোখ বড় করে তাকায়।

পটকা ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে গা’য় নীল রঙের কাগজ মোড়া ১টা, ২টা, ৩টা বোতল বের করে।

৩টে মোটে?মদন অবাক হয়।

না, আরো আছে।

কিনলি?

মদনের এই প্রশ্নে পটকা হাসে। আমি কেনবো? কামার পাড়া রেইড করে পুলিশ ১৩৬ বোতল ধরেছে, সেখান থেকে ২০ বোতল মেরে দিইছি।

সিজার হঠাৎ টেবিলে একটা থাবা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, সাবাস শালা পটকা, এই না হলে ক্যাডার? সরকার তুমি এগিয়ে চল আমরা আছি তোমার সাথে। বলে হি হি করে হেসে ওঠে, সাথে অন্যরাও হাসে।

পটকার পাঞ্জাবীর বাম পকেট যে ঝুলেই থাকে তার কারণ সেখানে রয়েছে তার প্রিয় জিনিস। একটা কামারে পিস্তল। নানা ধরনের ঝুঁকি আর হুমকি থাকা সত্ত্বেও এই পিস্তল সে কিছুতেই হাত ছাড়া করেনি। এটা থাকলে তার সাহস বাড়ে, মনে বল পায়।

কদিন আগে গুরগোল্লার মোড়ে রাস্তার ধারে টোঙের ভেতর বজলু এসআইকে চা খেতে দেখে পটকা এগিয়ে গিয়েছিল। রাত তখন সাড়ে ১১টা, ১২টা হবে।

স্যার এখেনে? পটকা জিজ্ঞেস করেছিল।

আমাদের কি আর এখেনে সেখেনে আছে রে, ক্রিমিনাল দাবড়াচ্ছি।

কে, ভ্যান খালেক? —বজলু এসআই মাথা নাড়লে পটকা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ধরেন তো, ধরে আচ্ছা মত ঠ্যাঙানি দেন, শালা খানকির ছেলে আমাদের এমপি চাচার বিরুদ্ধে এত বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে!

বজলু এসআই অকস্মাৎ পটকার পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়, কিরে এখনও এই মাল নিয়ে ঘুরছিস?

পটকা হেসে ফেলে। বোঝেন তো স্যার, কত ঝামেলা ঝক্কি থাকে, এটা থাকলে মনে বল পাই।

কিসের বল! বজলু এসআই অবাক হয়; এই সব কামারে মালের কোনো ভরসা আছে? সোজা মারবি তো ডানে যাবে, না হয় বামে যাবে, টার্গেট মিস, তার থেকে বিদেশী মাল রাখ।

রেখেছিলাম স্যার, তাৎক্ষণিক জবাব দেয় পটকা। তা খুব ঝামেলা, এ চায় সে চায়, ভাবলাম আমার দেশী মালই ভাল। কেউ চায়-টায় না। আর টার্গেট মিস হবে কি, হিট হয় তো বডিতে ঠেকিয়ে, ডানে বায়ে কদ্দুর সরবে?

বজলু এসআই হা হা করে হেসে ওঠে। পটকার ঘাড়ে একটা আদুরে থাবা বসিয়ে বলে, হারামজাদা, যা সিগরেট নিয়ে আয়।

সে দৌড়িয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগরেট এনে দিলে বজলু ১টা সিগারেট ধরায়।

এই ফাঁকে পটকা বলে, এখন তো খুব আদর দেখাচ্ছেন, সরকার পাল্টি খালি তো ছাইগুষ্টি সব ধরে প্যাদানি দেবেনেন।

বজলু এসআই এর ঠোঁটে ধরা জ্বলন্ত সিগরেটটা একটু দুলে ওঠে। তারপর সে দার্শনিকের মতো উক্তি করে,—বুঝিসনে, সরকারি চাকরি করি তো, তা তোদের সমস্যা কি? সরকার পাল্টাবে, তুরাও পাল্টাবি!

টেবিল ঘিরে বসা সিজার, পটকা মদন শিমুল আরও নাম না জানা দু’জনের সামনে ৩ বোতল ফেনসিডিল পর পর সাজান। ধ্যানমগ্নের মত তারা তাকিয়ে আছে সেদিকে। ফেনসিডিল তারা যে খায় না এমন না, তবে পার্টি আফিসে বসে ফেনসিডিল খাওয়ার ব্যাপারটা তাদের কাছে নতুন এবং রোমাঞ্চের।

গুরু, মদন বললো, তুমি তো আমাদের লিডার, তুমিই শুরু করো।

হ্যাঁ, আমিই শুরু করবো, সিজার বললো, আমি কারো ভয় পাইনে বুঝলি? সব শালাকে চিনি।

এ পর্যন্ত বলে সে ছোঁ মেরে একটা বোতল তুলে নেয় তারপর দু’হাতের তালুর মধ্যে চেপে ধরে মুটকিতে এমন জোরে মোচড় দেয় যে সেখান থেকে আর্তনাদের মতো শব্দ ছুটে আসে।

নিষেধের বাঁধ খেয়ালী-কপোত ডানা

মো. জাকারিয়ার রাজনৈতিক জীবনে বলা যায় আজকে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

দুপুরের পর থেকে তাঁর মনটা এত খারাপ যে দুপুরের খাবার খেতেও সামান্য আগ্রহ হলো না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যে। সে চলে এল সোজা পর্টি অফিসে। সম্পাদকের ঘরটা এখন নির্জন। নিরিবিলি একা, আজকের সারাদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে সে ভাববে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁর নিতে হতে পারে। সে যখন উপরে উঠে আসে তখন নীচের হল ঘরে সন্ধ্যের আলো জ্বলেছে। আলোটা পর্যাপ্ত না, সে খেয়াল করেছে কিন্তু ঘরে কারা ছিল এটা তাঁর চোখে পড়েনি। দরজার কাছে তাঁর দেখা হলো এ অঞ্চলের সবার চেনা সাদা-কালো রঙের স্বাস্থ্যবান বেওয়ারিশ কুকুরটার সাথে। ভয়ংকর চেহারা কুকুরটার কিন্তু আসলে নিরীহ। সুযোগ পেলে সে পার্টি অফিসে ঢোকে, কারো খেয়ে ফেলা ভাঙা বিস্কুট কেক্ বা মাটিতে ছড়িয়ে পড়া চ্যানাচুর খোঁজ করে। কুকুরটা পার্টি অফিস থেকে বের হচ্ছিল। মো: জাকারিয়ার দিকে সে চোখ কুঁচকে তাকায়, চোখাচোখি হয়, আর তখন কুকুরটা যেন মুখে মৃদু শব্দ করে জাকারিয়ার গা’য়ে লেজটা ঘষে দেয়।

জাকারিয়া দ্রুত উপরে উঠে আসে।

আজ সকালে যে ঘটনার সম্মুখিন সে হয়েছিলো সেটা তাঁর জীবনে শুধু অপ্রত্যাশিত ছিল না, ছিল চরম অকল্পনীয়। বাড়ীর বসার ঘরে যখন সে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে নানা শলাপরামর্শে ব্যস্ত তখন যাকে সে ঘরে ঢুকতে দেখলো তাঁকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ানো ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না।

স্যার আপনি!

হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইট প্রফেসর এক সময়ের প্রগতিশীল শিক্ষক গোষ্ঠির অবিসংবাদিত নেতা প্রফেসর ড: এ কে জোয়ার্দ্দার ঘরে ঢুকলেন। তারপর হাতের মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে বসে পড়লেন।

জাকারিয়া মিষ্টির প্যাকেটের দিকে তাকালো এবং তাঁর স্যারের দিকে। কি বিশাল ব্যক্তিত্ব আর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন এই স্যার। সুঠাম ঋজু শরীর,স্পষ্ট কথাবার্তা। তাঁর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে পারলেই যেন স্বস্তি পেত ছাত্ররা। অথচ তিনি ছিলেন ছাত্র-বান্ধব, আন্তরিক। এ ক’বছরে তাঁর চেহারা পাল্টিয়েছে। চুলগুলো সব সাদা, মুখে স্পষ্ট বলিরেখা। মনে হচ্ছে যেন বার্ধক্য চেপে বসেছে তাঁর সমস্ত শরীরে।

স্যারের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখে নিজের কাছেই নিজেকে কেমন ছোট মনে হলো জাকারিয়ার। তাঁকে খবর দিলেই কি সে ছুটে যেতে পারতো না?

বড়ো বিপদে পড়েই তোমার কাছে এলাম, স্যারের গলা বিপর্যস্ত, ভঙ্গুর, শুনেছি তুমি রুলিং পার্টির ভাল পজিশন হোল্ড করছো, তা আমাকে একটু না দেখলে তো হয় না।

সমস্যাটা জাকারিয়া মনযোগ দিয়ে শুনলো। এই শহরের রায়পাড়ায় কোনো এক সময়ে তিনি এক টুকরো জমি কিনেছিলেন। কিছুদিন আগে খবর পেয়েছেন সেই জমিতে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনে কারা যেন ঘর তুলছে। তিনি তাদের সাথে দেখা করেছেন, তারা বুঝিয়েছে যেহেতু তারা কাঁচা ঘর তুলছে সেহেতু এটা দখল না, জায়গাটা তারা কাজে লাগাচ্ছে মাত্র। এর মধ্যে তাদের কেউ একজন স্যারের সাথে যোগাযোগ করে শর্ত দিয়েছে যে যদি তাদেরকে ৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় তবে তারা দখল ছেড়ে দেবে। স্যার থানায় গিয়েছিলেন; থানা পরামর্শ দিয়েছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলতে।

স্যারের কাছে এই বৃত্তান্ত শুনে জাকারিয়া আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লো। তাৎক্ষনিক স্যারকে সাথে নিয়ে সোজা চলে গেল ডিসি অফিসে। সৌভাগ্যক্রমে ডিসি সাহেব অফিসে ছিলেন। ল্যাংড়া রশিদ আর দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে খোলা মনে গল্প করছিলেন।

জাকারিয়াকে দেখে ডিসি সাহেব সহাস্য সম্ভাষণ করলেন,এই যে ইয়ংস্টার আসুন, এই বারই তো আসর জমবে।

কিন্তু জাকারিয়া ডিসি সাহেবের সাথে স্যার প্রফেসর ড. একে জোয়ার্দ্দারকে পরিচয় করিয়ে দিলে আসর আর জমলো না। বিস্তারিত ঘটনা ডিসি সাহেবকে বললো জাকারিয়া। তিনিও মনযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর চা’র কথা বলি,-এই কথা বলে চা’র অর্ডার দিয়ে একটু ভেবে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,-আইনের দৃষ্টিতে কথাটা তারা যে খুব ভুল বলেছে তা কিন্তু না। দখল বলতে আসলে পাকা স্থাপনা অর্থাৎ ব্রিক ওয়ার্কসকে বোঝায়, তা আপনার সমস্যা কি? এখন তো আর কিছু করছেন না, যখন করবেন আমার বিশ্বাস ওরা নিশ্চই উঠে যাবে।

এটা কোনো কথা হলো? জাকারিয়া একটু উত্তেজিত হয়ে গেল।

কথাই তো হলো, আমি তো বেসিক কথাটাই বললাম। ডিসি সাহেব মৃদু হাসলেন।

জাকরিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। কিছু সময় তাঁর মুখ দিয়ে কথা সরলো না। তারপরও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে সে বললো, না, ওটা বেসিক কথা না, বেসিক কথা হলো আপনাকে ঐ জমিটা দখল মুক্ত করে দিতে হবে।

হাস্যোজ্জ্বল ডিসি সাহেবের মুখটা কেমন নিথর হয়ে গেল।

হ্যাঁ দেব, তবে এমপি সাহেবকে দিয়ে আপনাকে ফোন করাতে হবে।

এমপি সাহেব! জাকারিয়ার গলা চড়ে গেল, এমপি সাহেব কেন, আপনি আমাকে চেনেন না?

না চিনি না, নির্লিপ্তভাবে ডিসি সাহেব বললেন, আপনি কে?

ঠিক আছে আমি কেউ না, দেশের নাগরিক তো? জাকারিয়ার গলা কাঁপছে, সমস্ত শরীর জুড়ে যেন উত্তেজনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দেশে আইন-কানুন বিচার-বিবেচনা কিছুই কি নেই?- আর্তনাদের মতো শোনালো জাকারিয়ার গলা।

দেশে আইন-কানুন বিচার-বিবেচনা কোথায় কতটুকু আছে আমার থেকে আপনি কি কম বোঝেন জাকারিয়া সাহেব? আগের মতই নির্লিপ্ত ভাবে ডিসি সাহেব বললেন, —যান, এখানে সিনক্রিয়েট না করে স্যারকে নিয়ে এমপি সাহেবকে যেয়ে ধরেন, তাঁর যদি দয়া হয় আমাকে ফোন করে বললে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

জাকারিয়া আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। উত্তেজনার চরমে উঠে স্প্রিংয়ের মত লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো, সব শূয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেব, ঠগ, বাটপার।

ল্যাংড়া রশিদও মার মুখো হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, হুংকার দিয়ে বললো, জাকারিয়া, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

মুহূর্তকাল দেরি না করে ঝড়ের গতিতে জাকারিয়া বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পেছনে প্রফেসর ড. এ কে জোয়ার্দ্দার। জাকারিয়ার নাগাল ধরতে তিনিও দ্রুত পা চালালেন আর ডাকতে লাগলেন,—জাকারিয়া, ও জাকারিয়া। একসময় জাকরিয়া ঘুরে দাঁড়ালো। দু’হাত জোড় করে মিনতি করে বললো, প্লিজ স্যার, প্লিজ। বলেই দ্রুত পা চালিয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে ডিসি অফিসের পরিবেশটা তখন ভারী হয়ে উঠেছে।

থমথমে মুখে ডিসি সাহেব তাকালেন ল্যাংড়া রশিদের দিকে, দেখলেন তো সিচুয়েশনটা?

ও একটা শয়তান স্যার, বানচোৎ, আমি আজকেই এমপি সাহেবকে পুরো ঘটনাটা বলবো।

প্লিজ, ডিসি সাহেব যেন অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনাকে কাউকে কিছু বলতে হবে না, আর শুনুন,কিছু মনে করবেন না, আপনাদের এমপি সাহেব হচ্ছে একটা নাম্বার ওয়ান ইডিয়েট বুঝলেন?

ল্যাংড়া রশিদের চোখ ঘোলা হয়ে গেল। মাছের মতো পলকহীন সে তাকিয়ে থাকলো ডিসি সাহেবের দিকে।

বন্ধ দুয়ার রুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস

পূর্বাপর ঘটনাটা মো. জাকারিয়া যাচাই করলো। না, তাঁর কিছুই করার ছিল না। সে যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল তার কারণটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনার জের এখনও আছে, সেটা টের পাচ্ছে। মাথার মধ্যে থেকে থেকে যেন বিদ্যুতের চিড়িক দিচ্ছে।

আবার কি সে উত্তেজিত হয়ে উঠছে? সে, মো. জাকারিয়া, ফলিত রাসায়নে অনার্স, মাস্টার্স, সব ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে এসেছে শুধু নিজের জন্য না, দেশের জন্য, মানুষের জন্য। বিনা কারণে তাঁকে অপমান করলে, অপদস্ত করলে, সে মেনে নেবে? তাই হয়!

টেবিলের উপর সজোরে একটা কিল বসালো সে, তারপর একটা সিগরেট ধরালো।

শরীরটা একেবারে নির্ভার করে দিয়ে সিগরেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যে, না আর না, হয় তাঁকে এই অবস্থান থেকে একেবারে সরে আসতে হবে, অথবা যে ঘটনায় আজ সে নিজেকে বেশামাল করে ফেললো, এ জাতীয় অথবা এর থেকে আরও নিকৃষ্ট পরিস্থিতি রপ্ত করার মতো যথেষ্ট বিবেকহীন হয়ে উঠতে হবে তাঁকে।

তাঁর পথ কোনটা?

হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলো জাকারিয়া। রাত বেশ হয়েছে। খোলা জানলা দিয়ে সারাসরি চোখ যেয়ে ঠেকলো বাইরের এক টুকরো রূপালী আকাশে। নিপাট জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে আকাশ, এরকম সে কি দেখেছে কোনোদিন? অভিভূতের মতো কতক্ষণ সে চেয়ে থাকলো সেদিকে।

জানলা সে বন্ধ করলো না, এমনকি ঘরের বাতিটাও নিভালো না, দ্রুত সে নেমে গেল নীচে।

নীচের ঘরে টেবিল ঘিরে তখন অনঢ় মূর্তীর মতো বসে আছে সিজার পটকা শিমুল মদন, আরও নাম না জানা দু’জন।

কি ব্যাপার এত রাতে তোমরা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো জাকারিয়া।

ইয়েস বস্,সিজার ওদের নেতা, নির্দ্বিধায় সে বললো, আমরা মাল খাচ্ছি।

সিজার, ধমক দিয়ে উঠলো জাকারিয়া।

ইয়েস বস্,সিজার উঠে দাঁড়ালো, আমরা মাল খাচ্ছি আর ফূর্তি করছি।

সিজারের চোখ দু’টো কেমন অস্বাভাবিক লাগলো। মুখজুড়ে যেন সাপের নাচন। জাকারিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল।

আপনিও বস্, আমাদের সাথে ফূর্তি করবেন। সিজারের ঠোঁটের কোনায় এক টুকরো নির্মম জেদ ঝুলে পড়লো।

এসব কি বলছো তোমরা?

আমাদের গুরু ঠিকই বলেছে বস্, আমরা মাল খাবো, ফূর্তি করবো, আপনি লস্ট জেনারেশন বলে বক্তৃতা করে বেড়াবেন, তাতো হবে না বস্। এই কথা বলার জন্য মদন যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল।

সিজার কিছু একটা ইশারা করলে ওরা উঠে ঘিরে ধরলো জাকারিয়াকে; দরজায় যেয়ে দাঁড়ালো দু’জন।

তাদের সবারই চোখ ভারী আর লাল, মুখে ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠার উল্লাস।

সিজার একটা ফেনসিডিলের বোতল জাকারিয়ার মুখের কাছে তুলে ধরে বললো, -প্লিজ বস্, মাত্র দু’ঢোক, —বলেই সে খিক করে হেসে উঠলো।

জাকারিয়া হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে ফেনসিডিলের বোতলটা ছিটকে পড়লো।

মনে হলো না এই ঘটনায় কারো কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই মেনে নিল ঘটনাটা, শুধু তারা আরও একটু ঘনিষ্ট হয়ে এল।

টেবিলের তলা থেকে আর একটা ফেনসিডিলের বোতল বের করে খুব মনোযোগ দিয়ে মুটকির প্যাঁচে মোচড় দিয়ে সিজার বললো, বস্, এতগুলো ক্যাডার আমরা আপনাকে রিকোয়েস্ট করছি, আপনি শুনবেন না? আমরা তো শুনি, উইথআউট এনি কোশ্চেন আমরা তো ঝাপিয়ে পড়ি আপনাদের অর্ডারে।

সিজার মদন প্লিজ, আমার কথা শোন প্লিজ, তোমাদের মতো আমিও, আমিও- জাকারিয়ার শরীর কাঁপে, গলা কাঁপে, বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো, দু’হাত জড়ো করে সে অনুনয়ে সিক্ত হতে থাকে।

অচমকা পিঠের কাছে কিসের স্পর্শে সে সচকিত হয়। আর পেছন ফিরে তাকাতেই পটকা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে দিলো।

জাকারিয়া ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

পিঠের ঠিক মাঝখানে পিস্তল ধরেছে পটকা।

বডি টাচে টার্গেট মিস হবে না বস্, ডানে বামে কতদূর সরবে, পটকা বললো।

জাকারিয়ার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ঘরের ভেতরের আলো ক্রমশ নিস্প্রভ হয়। বুভুক্ষার মতো চারিদিকে তাকায় সে। জানলা সব বন্ধ, দরজায় দু’জন দাঁড়িয়ে। খোলা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস কি সে নিতে পারবে না?

সিজারের হাতে মুখ খোলা ফেনসিডিলের বোতল জাকারিয়ার মুখের কাছে উঠে আসে আর কটা আত্মবিনাশী কৌতুক-চোখ তাঁকে ঘিরে নাচে।

শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে শ্বাস কাজটা চালায় জাকারিয়া। হঠাৎ জোৎস্নায় প্লাবিত এক টুকরো রূপালী-আকাশের প্রত্যাশায় তাঁর চোখ দু’টো কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় আর বন্ধ দরজা জানলাগুলোর উপর তীব্র বেগে আছড়ে পড়তে থাকে। তখন ভেঙেচুরে চুরমার হওয়া ছাড়া তাঁর আসলে আর কোনো উপায় থাকে না।

ঘরের ভেতর উম্মত্ত হাসির ঘূর্ণি ওঠে এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ জাকারিয়াকে ঘিরে কতগুলো আদিম প্রাণী মহা-মচ্ছবে মাতে।

(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ১১,২০১৯)