ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য কুরবানী
আবুল বাশার
'কুরবনী' আরবি শব্দ। এর মূল শব্দ হল 'কারবুন' বা 'কুরবুন'। যার শাব্দিক অর্থ হল 'নিকটবর্তী হওয়া', নৈকট্য লাভ করা', 'উৎসর্গ করা'। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, "নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করার নাম কুরবানী।" মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু ত্যাগ করার নামই কুরবানী। হোক না তা সময়, শ্রম, মেধা, যোগ্যতা কিংবা অর্থ। আলোচ্য নিবন্ধে কুরবানীর মৌলিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হল।
কুরবানীর সূচনা
আমরা অনেকেই মনে করে থাকি কুরবানীর সূচনা ইবরাহীম (আ) এর সময় থেকে শুরু হয়েছে। আসলে তা নয়। কুরবানীর সূচনা হয়েছে পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ) এর সময় থেকে। আদম (আ) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য কুরবনী দেন। তাদের একজনের কুরবানী কবুল হয়, অন্য জনেরটা কবুল হয় না। পশু কুরবানীর সূচনা হয় ইবরাহীম (আ) এর সময় থেকে। আর প্রতি বছর পশু কুরবানীর সূচনা হয় সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর সময় থেকে।
কত টাকা মূল্যের পশু কুরবানী দিতে হবে?
আমরা মনে করি যে যত বেশি মূল্যের পশু কুরবানী দেবে সে তত বেশি সওয়াব অর্জন করবে। আসলে তা নয়। আল্লাহ তায়ালা দেখে নিতে চান কে সর্বোত্তম কাজ করল তাই। কে বেশি কাজ করল তা নয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, "তিনি সেই সত্ত্বা যিনি জীবন ও মরন সৃষ্টি করেছেন এ পরীক্ষা করার জন্য যে, কে সর্বোত্তম কাজ করে।" এখানে কিন্তু কে বেশি কাজ করে তা বলা হয়নি।
ধরুন এক ব্যক্তি দশ লক্ষ টাকা মূল্যের গরু কুরবানী দিল। এতে কী হল? এলাকায় ধন্য ধন্য রব উঠল যে, ওমুক দশ লক্ষ টাকার গরু কুরবানী দিয়েছে। কুরবানী শেষ হল, গরীবেরা, আত্মীয়েরা গোস্ত নিয়ে গেল। দু'বেলা পেট ভরে খেল। এপর্যন্তই শেষ। এতে কুরবানী দাতা একটি কুরবানীর সওয়াবই পাবে। পক্ষান্তরে সে যদি এক লাখ টাকার গরু কিনে কুরবানী দিত তাহলে ত তার জন্য যথেষ্ট হত। বাকী নয় লক্ষ টাকা নয়টি হত দরিদ্র পরিবারে দান করত তাহলে নয়টি পরিবার সচ্ছলতা ফিরে পেত। ঐ নয়টি পরিবারের সকল সদস্য আজীবন তার জন্য দোয়া করত। আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে তাকে নয়টি কুরবানীর সওয়াব দিতে পারতেন।
কুরবানী আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহা পরীক্ষা
আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আ) কে অনেকগুলো পরীক্ষা নেন। সবগুলো পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। কুরবানীর বিষয়টিও ছিল তার জন্য বড় একটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষা যেনতেন পরীক্ষা নয়। এটি আত্ম ত্যাগের পরীক্ষা। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার পরীক্ষা। এ পরীক্ষায়ও তিনি অত্যন্ত সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।
কুরবানীর এ পরীক্ষা ইবরাহীম (আ) কে আগুনের কুণ্ডলীতে ফেলানোর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। আগুনে ফেলানোর সময় ইবরাহীম (আ) ছিলেন একা। আর কুরবানীর পরীক্ষার সময় ইবরাহীম (আ) এর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল তিনজন। তিনি নিজে, বিবি হাজার ও শিশুপুত্র ইসমাইল।
যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নিজের সন্তানকে জবাই (কুরবানী) করার হুকুম করা হল তখন তার মনের মধ্যে তো এ বিষয় উদিত হতে পারত যে, ইসমাইলকে কুরবানী দিলে আমি ছেলে হারা হয়ে যাব। আমার বংশে বাতি জ্বালানোর মত কেউ থাকবে না।
ইবরাহীম (আ) আল্লাহর কাছে এ আরজীটাও পেশ করতে পারতেন যে, হে আল্লাহ এই শেষ বয়সে এসে একমাত্র সন্তানটাকে না নিলে হত না? আমিই তো কত কাকুতিমিনতি করে তোমার কাছ থেকে এ সন্তান পেয়েছি। শেষপর্যন্ত কুরবানীর জন্য তাকেই নির্ধারণ করলে? ইসমাইলকে নিয়ে গেলে আমার পরে তোমার দ্বীন কে প্রচার করবে?
এগুলোর কোনটিই তার মধ্যে উদিত হয়নি। তা ছাড়া শিশুপুত্র ইসমাইলকে তার পিতা সরাসরি বলেছিলেন যে, তাকে জবাই করতে বলা হয়েছে। ইসমাইল (আ)ও কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করে বলেছিলেন, 'হে আমার পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা পালন করুন। এখনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবে পাবেন।
সকল কাজে তাদের ঐক্যমত্যের একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল, "শুনলাম এবং মেনে নিলাম"। সর্বদা তাদের বিশ্বাস ছিল যে, "আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমাদেরকে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।"
অবশেষে কী হল? শিশুপুত্র নয়। তার বদলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেয়া হল কুরবানীর জন্য। কেন? কারণ, আল্লাহ আমাদের জন্য সকল কাজ সহজ করে দিতে চান। কঠিন করে দিতে চান না।
ইবরাহীম (আ) যদি ছেলে কুরবানী দিতেন তাহলে আমাদেরকেও ছেলে কুরবানী দিতে হত। এমন হলে তা আমাদের জন্য তা বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন হয়ে যেত।
রাসূল (সা) বলেছেন, "কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়।" অর্থাৎ, আল্লাহ তা কবুল করে নেন।
কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, "আল্লাহর কাছে (কুরবানীর) গোসত আর রক্ত কোনটাই পৌঁছায় না। বরং তার কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।"
সুতরাং, যার তাকওয়ার পরিমাণ যত বেশি তার কুরবানী কবুল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। যারা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পেরেছে কুরআনে তাদেরকে মুত্তাকী বলা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে আরও বলা হয়েছে যে, "আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের কর্মকাণ্ডই কবুল করে থাকেন।" মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন মজীদের সূরা বাকারার ২-৪ নং আয়াতে এবং একই সূরার ১৭৭ নং আয়াতে মুত্তাকীদের বেশ কিছু গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। আমরা সেগুলো পড়ে নেব ইনশাআল্লাহ।
কুরবানীর শিক্ষা
কুরবানীর ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যে শিক্ষা দান করেছেন তার মধ্য থেকে পাঁচটি মৌলিক শিক্ষা পাঠকদের খেদমতে তুলে ধরছি।
১নং শিক্ষাঃ আল্লাহর হুকুম দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া।
২নং শিক্ষাঃ আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন করা।
৩নং শিক্ষাঃ বিপদ, মুসিবত যাই আসুক সর্বাবস্থায় আল্লাহর দ্বীন কায়েমের পথে অটল থাকা।
৪নং শিক্ষাঃ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা পেশ করা।
৫নং শিক্ষাঃ মানবতার কল্যাণে সর্বদা নিজেকে নিয়জিত রাখা।
কুরবানীর মূল শিক্ষা হল ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়া। মানবতার সেবায় নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, সময়, শ্রম ও অর্থ বিলিয়ে দেয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তার সন্তুষ্টির জন্য কবুল করুন। আমীন।
লেখক: আলেমে দ্বীন ও গবেষক
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ১১,২০১৯)