১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার কোটি টাকা
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: খেলাপি ঋণের বিপরীতে আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষা করতে বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এতে বেড়ে চলছে প্রভিশন ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে সরকারি, বেসরকারিসহ ১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। এ বিশাল অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতিতে বেড়ে যাচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জুন প্রান্তিকের প্রভিশন ঘাটতি পরবর্তীতে সমন্বয় করতে না পারলে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে, সেই সাথে কমে যাবে ব্যাংকের আয়। এতে শুধু ব্যাংকিং খাতেই ঝুঁকি বাড়বে না, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করছেন।
প্রভিশন ঘাটতি থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৪টি সরকারি ও ৯টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর অন্যতম একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। কোনো ঋণখেলাপি হয়ে গেলে ঋণের শ্রেণিভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়, অর্থাৎ ব্যাংকটি যে পরিমাণ আয় করে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় ঘাটতি দেখা দেয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংকের রিটেইন আর্নিং কমে যায়। এভাবে পরবর্তীতে সমন্বয় করতে না পারলে মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়। আর সেই সাথে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয়ও (ইপিএস) কমে যায়। আয় কমে গেলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর দীর্ঘ দিন ধরে প্রভিশন ঘাটতি চলছিল। সাথে ছিল বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আইসিবি ব্যাংক। কিন্তু কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতের দু’টি ব্যাংকের সাথে আরো কয়েকটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি যুক্ত হয়েছে। যেমনÑ গত জুনে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা দু’টি ব্যাংকের সাথে আরো সাতটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক যুক্ত হয়েছে প্রভিশন ঘাটতির তালিকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে সমস্যাকবলিত বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির গত জুন শেষে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে তিন হাজার ৭৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের বিপরীতে পাঁচ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু আয় সংস্থান করতে না পারায় আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে অর্ধেকের কম অর্থাৎ দুই হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের পর সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। ব্যাংকটি আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সাত হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে পাঁচ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সরকারি খাতের অপর ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের আলোচ্য সময়ে ৯৮২ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ৮৫২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে হালে নানা কারণে বেকায়দায় থাকা এবি ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিপরীতে দীর্ঘ দিন ধরে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। বরং দিন দিন ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে চার হাজার ৫৯২ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণের কথা ছিল। কিন্তু আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পেরেছে মাত্র ৯৯৯ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে তিন হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। তেমনিভাবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারায় আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১১ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৩২৯ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১২৬ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৭২৭ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৭০ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০৩ কোটি টাকা এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৮৩ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রভিশন ঘাটতি পরবর্তীতে সমন্বয় করতে না পারলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা যায়। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনের জন্য যে হারে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল তা করতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে। লেনদেন সমন্বয় করতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যয়।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/আগস্ট ২৯ ,২০১৯)