আ ফ্রাইডে
শাহনাজ পারভীন
কয়দিন ধরেই পৃথিবী ভাবছে, একটু গল্প খুঁজতে বের হবে। কিন্তু সময়ের বড্ড অভাব। এই সোনার হরিণের সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কাজকর্ম কোনও মতো গুছিয়ে উঠতে পারলেও ‘অকাজের কাজ’ গল্প খোঁজার সময় আর পৃথিবীর হয়ে উঠছে না। তাই আজ ছুটির দিনের সকালটা অন্য আর চারটে সপ্তাহের মতো আয়েশ করে না ঘুমিয়ে পৃথিবী ভোর করেই আরামের বিছানা ছাড়লো। আজ পৃথিবীর সারাদিনব্যাপী ছক কাটা সেসময়।
শুধু আজ নয়। পুরো সপ্তাহ জুড়েই ছুটির দিনসহ। তাই আজ শুধু আয়েশ করে বিছানা ছাড়াটা ও বাদ দিলো। কারণ তাকে আজ ছকের সব কাজই শেষ করতে হবে দিনের মধ্যেই। তাই নতুন করে গল্প খোঁজার কাজের জন্য সময় বের করতেই তাকে ভোর করে বিছানা ছাড়তে হলো। অন্য আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতো আয়েশ করে বিছানায় থাকতে পারলো না ও।
আবছা আলোয় ফজরের নামাজ শেষ করেই ছাদে চলে এলো। ছুটির দিন সকালটা ও ছাদ বাগানে কাটায়। এ ওর বহুদিনের অভ্যাস। শুধু অভ্যাস কেন, বিলাসিতাও বলতে পারেন।
ওর সারা বাড়িতেই কিছু না কিছু গাছ ছড়ানো। ছিটানো। ওর লম্বা দখিনের ব্যলকনিতে বাইশটি টব রাখার মতো জায়গা। যখন যেটাতে ফুল আসে, তখন সে সেটা ওখানে রাখে। ফুল ফোটা শেষ হলে আবার ছাদে। কনটিনিউ ব্যালকনির বাগানটা ভরে থাকে ফুলসহ গাছে। প্রত্যেকটি সিঁড়িতে ফুলসহ ছোট ছোট ক্যাকটাস। ছোট্ট একটি বাড়ি 'বুনোপাখি'। কিন্তু অসামান্য সুন্দর। শুধু গাছের জন্যই। পৃথিবী সেটা জানে।
আজ চৌঠা শ্রাবণ। আকাশ শুষ্ক। বৃষ্টির গন্ধ নেই কোনও মাটিতে। পোড়া মাটিতে ভাপ উঠছে যেন। কাঁচা মাটিতে পোড়া মাটির গন্ধ। আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। এই নরম সকালেই দগদগে সূর্য গনগনে করছে যেন ওর ছাদের চৌদিকে। প্রত্যেকটা টবের গাছ শুকিয়ে ন্যাতানো। গাছের গোঁড়ার মাটি ফেটে চৌঁচির। এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই ওর এখন। অথচ অন্য সময় শ্রাবণের আকাশ ঝরঝর কেঁদে ফেরে যখন তখন। আর এখন গোমড়া মুখে বৃষ্টির জন্য অভিমানে গাল ফুলিয়েছে। কিন্তু কে দেখে কার গাল ফোলানো। মেঘ, হাওয়া। মধুমতি ছেড়ে সে গেল কোথায়?
পৃথিবীর মনে পড়ে ছোট বেলায় মধুমতির বুকের ওপর পাতলা মেঘের সরের আকাশ ভেসে বেড়াতো। পেজা তুলার মতো আকাশময়। ছেঁড়া, ছেঁড়া, কুচি, কুচি মেঘ রংয়ের মতো স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ। কচি কলা পাতা মায়া জড়ানো যেন। আহা কি সুন্দর সে দৃশ্য! ও দ্রুত হাত লাগায়। এ গাছ থেকে ও গাছের কাছে যায়। নাইট কুইনটায় চমৎকার কুড়ি সাপের মাথার মতো ফনা তুলে বাতাশের সাথে সাথে এ পাশ ওপাশ দোল খাচ্ছে। আজ রাতেই ফুটবে সে। হঠাৎ তাকে দেখে পৃথিবীর খারাপ লাগাটা উবে গেল। বার বার কুড়িটাকে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো পৃথিবী। অথচ তার পাশেই যে ফুটে আছে টকটকে লাল রংয়ের থোকা থোকা রাঁধাচুড়া, রঙ্গন আর হলুদ অ্যালমন্ডা।
তা নিয়ে আজ আর পৃথিবীর কোনও মাথা ব্যথা নেই। অথচ একটা সময় সেখানে ফুল ফোটাবার কি নিঃসীম প্রচেষ্টা!
মানুষ আসলে এই রকমই। না পাওয়া জিনিসের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করে। রাধাচুড়া-- যে সারা বছরই ফুটে থাকে তাই আজ তার আকর্ষণ হারিয়ছে। কিন্তু নাইট কুইন যে বছরে একবার তাও মধ্যরাতে, অল্প কিছু সময়ের জন্য ফোটে। তাই তাকে নিয়ে এত মাতামাতি!
সূর্য বাসায় নেই। সে যখন বাসায় থাকে তখন প্রতিদিন সকালে সে নিয়মিত পৃথিবীর জন্য দুটি কাজ করে। পৃথিবী সকালে লাল আটার দুটো রুটি খায় রোজ। এক বাটি সবজি, একটি ডিম পোচ, এক কাপ লাল চা। ছুটির দিন সকালে খিচুরি, ডিম ভাজি, নানান রকম আচার, শসার সালাদ। ব্যস। সকালে কাজের চাচী সব রান্না করে। সবজী বানায়। ডিম পোচ করে। সকালে পৃথিবীর জন্য এক কাপ দুধ চা বিস্কিট ট্রেসহ খাটে এনে দেয়। আয়েশ করে চা খেয়ে ও খাট থেকে নামে। সারাদিনের মধ্যে এটুকুই চাচীকে নিয়ে পৃথিবীর বিলাসিতা। আর সব কাজ সে নিজ হাতেই করে। চাচী রান্না শেষে ঘর পরিষ্কার করে ওর নাস্তা শেষ করার আগেই চলে যায় রোজ। কিন্তু পৃথিবীর পছন্দ গরম রুটি। সূর্য এই কাজটি নিয়মিত করে। ওর গোসল শেষ হলে সূর্য ম্যাজিক চুলোটা অন করে চট করে দুটো রুটি ছেকে দেয়। ভাপ ওঠা রুটির ফোলা পেট ছিঁড়ে গরম ভাপ বের করাও পৃথিবীর বিলাসিতা। যেখানে শত শত কর্মজীবি নারী প্রতিদিন
টিফিন বাটি ভরতে ভরতে অফিস টাইমের সাথে দৌঁড়ায় সেখানে লাল আটার ভাঁপ ওঠা গরম রুটির পেট আয়েশ করে ছিড়তে পারাকেই পৃথিবীর বিলাসিতা মনে হয়।
আর দ্বিতীয় কাজটি হলো ওর গোসল শেষে ফেলে রাখা রাতের পোশাক পাতলা টপ্স, স্কাট রোজ ব্যলকনিতে রৌদ্রে মেলে দেয় সূর্য। বারান্দার দরজায় ও ভিজে কাপড় রেখে বেডরুমে ঢোকে অফিসের পোশাক ঠিক করতে। পৃথিবী রেডি হয়ে বের হতে হতে সূর্য ঠিকই সুন্দর পাট পাট করে মেলে দিয়ে ক্লিপ এঁটে দেয় ওর ভেজা কাপড়ে। ওর খুব ভাল লাগে। অন্য রকম ভাল। কিন্তু মুখ ফুটে কোনদিন কিছু বলতে পারে না। না থ্যাঙ্স, না ধন্যবাদ। হাসিমুখে টেবিলে যায়। সেখানে ভাপ ওঠা রুটি ওকে হাতছানি দেয়। প্রকৃত ভালবাসা আসলে এ রকমই। কিন্তু ওর মন কি চায়। একটুখানি নির্লজ্জ দুষ্টুমি, বাহুলতা। একটা দিন মাঝে মাঝে একটু ছেলেমানুষি? কিন্তু সূর্য একটি বারের জন্যও এলোমেলো হয় না। সারাক্ষণ জীবন মরণ সতর্কতা। ও বোঝে না, ঘরের মানুষের কাছে ব্যক্তিত্বের এত প্রহরার কি হলো। একটু এলোমেলো কথা, এলোপাতাড়ি...না থাক...
সূর্য যখন বাসায় থাকে না, পৃথিবীকে তখন এই কাজ দুটো নিয়মিত নিজেকেই করতে হয়। সেটি মাথায় রেখেই ছাদ থেকে নেমে এলো দ্রুত। অথচ ওর আরও কিছুটা সময় ছাদে থাকতে ইচ্ছে করছিল। ছাদে থাকলেই অন্য এক ভালবাসার কাছে থাকা যায়। ছাদ বাগানের নিজস্ব উঠোনে অসংখ্য ফুলের গাছ, গন্ধ। সূর্যকান্তি, ডাগরলতা, টাইমফুল, ক্যাকটাস, টগর, বেলি, অলকানন্দের হলদে পাপড়ি, সাদা গোলাপ, ডালিয়া, দোপাটি, জিনিয়াসহ বিরাট ছাদ বাগান। এক পাশে আলতো করে বেড়ে উঠেছে সিডবিহীন লেবু। একই থোকায় চারটি, পাঁচটি, ছয়টি লেবু। ডালে, ডালে, শাখায়, শাখায়। দুইটা আপেল কুল, একটি আমড়া, দুটি বেদানা, একটি কেজি পেয়ারা, একটি বিলম্বী ফল, একটি আম্রপোলী গাছ ওকে ছুঁয়ে রাখে আলতো করে। কিছু কাটাওয়ালা গোল বেগুন, লম্বা বেগুন, সবুজ শাক, পুই শাক, লাল শাক, কচু শাক, ঘ্যাটকোল, ঢেড়স, মরিচ গাছের লম্বা সাড়ি সতেজ। পৃথিবীর কাছে খোলা ছাদ মানে শব্দ তরঙ্গ। স্বরবৃত্তের কবিতা, নিটোল গদ্য, বহুবর্ণিল প্রভাত। একলা জগৎ, একলা কথা!
গোল বেগুন গাছের কোমল ডাটা, পাতা, ফুল জর্জরিত অসংখ্য জাবপোকায়, ইরিসাইফি এসপি'র প্রাদুর্ভাব গোলাপ, ডালিয়া, জিনিয়ায়। এসবের প্রতিকারেই কেটে যায় ওর সকালের কিছুটা সময়।
নীচেয় নেমে এসে দেখে কাজের চাচী এখনও বসে আছে। ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
কি ব্যাপার চাচী? যাও নি এখনও ? তুমি তো এতক্ষণ থাকো না তো কোনদিন।
না যাইনি এখনও।
কাজ শেষ হয় নি?
হইছে তো।
তো?
চাচা আমারে দুইডা কাজের দায়িত্ব দেছে।
বাড়তি দুইটি কাজের?
হু। চাচা কইছে যহন তোমার গোছল শেষ হবে তহন তোমারে দুইডা রুটি ছেইকা দিতে,
তারপর তোমার ভিজা কাপড় মেইলা দিতে। তারপর আমার ছুটি। চাচা যে কয়দিন না আসে, সেই কয়দিন ।
বাবারে! কি যে কও, না কও। ঠিক আছে?
হু। ঠিকই কইচি। চাচায় আমারে কইচে। বাড়ি আইসে এর দাম আলাদা দিবো।
পৃথিবী অন্য রকম খুশি হয়ে যায়। অন্য এক ভাল লাগার ঘোর নিয়ে ওয়াসরুমে ঢোকে।
আজ সে কোয়ান্টাম মেথডস এ যাবে। যেতে চাচ্ছে দীর্ঘদিন। আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ পেয়েছে অনেক বার। ছাত্র, বন্ধু, পরিচিত জন, অনেকেই বলেছে। ডেকেছে। কিন্তু সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার ওর প্রিয় লেখক বন্ধু মইনুলের আমন্ত্রণে যেতে রাজি হলো শেষ পর্যন্ত। মইনুল ওর প্রিয় লেখকদের একজন। সূর্যের মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কখনও কোনভাবেই তার ব্যক্তিত্ব এবং সচেতনতার ঋজুতা দেখেনি। ভাষার সৌন্দর্য অসামান্য। স্লাং ভাষা সে কোনদিন আড্ডায়ও ব্যবহার করেনি। তাকে সে সবার চেয়ে আলাদাভাবেই ভাবে। তো সেই মইনুল ওকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। ও না করতে পারে নি। তাছাড়া ওর নিজেরও যাওয়ার একান্ত ইচ্ছে। কারণ মেডিটেশান এর নানান উপকারিতা ও বিগত দিনে জেনেছে। তাই স্বশরীরেই থাকতে চায় একটা দিন। যদিও শহীদ আল বোখারী মহাজাতক এর নানান অডিও, ভিডিও সে দেখেছে। তার আন্দোলিত কণ্ঠ তাকে আকর্ষিত করেছে।
কিন্তু সূর্যকে সে এতকিছু বলতে চায়নি। আসলে ঠিক সেভাবেও নয়। কয়েক দিন জ্বর জ্বর ভাব। শরীরটা ভাল ছিল না। সে অবস্থায় এলো সপ্তাহের একটি আকাক্সক্ষার শুক্রবার! সে কি আজ বিছানা থেকে নামবে, কি নামবে না, সেটা নিয়ে কনফিউজ্ড ছিল। সারা সপ্তাহের বিরামহীন ছোটার পর ওর একটু রেস্ট প্রয়োজন। একটু পড়াশোনা, একটু আয়েশ। পুরোটা দিন ওর হাতের মুঠোয়! ভাবতেই অন্য রকম শিহরণে ও রোমাঞ্চিত হয়। কারণ নিজেকে সময় দেবার সময় কোথায়? নিজের সাথে বোঝাপড়া, নিজের সাথে সময় কাটানো ওর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।
তাছাড়াও আর একটি ভয় ওর মনে মনে কাজ করছিল। সূর্য জানতে পারলে ওকে যেতে দেবে কিনা?এর আগেও ও অনেক বার যেতে চেয়েছে। কিন্তু সূর্য ওকে অহেতুক কোথাও যেতে দিতে চায় না।
বলে, এগুলো নেশার মতো। পেয়ে বসলে ছাড়ানো যায় না। হিরোইন, গাজার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু পৃথিবী দেখতে চায় অজানাকে। চিনতে চায় অচেনাকে। সে একজন গবেষক, একজন লেখক। গবেষণার মননে সে মননশীল। জীবনের সবকিছুর ভেতরের গল্প সে দেখতে চায়, জানতে চায় অবলীলায়।
সম্প্রতি এক বন্ধু কোনও এক কথার উত্তরে সূর্য সম্পর্কে ওকে বলেছিল--
জড়িয়েই আছে সে। আপনি বুঝতে পারেন না। আপনি পৃথিবী সে সূর্য! না জড়িয়ে কি আর? হা হা হা
তখন ও তেমন কিছু বুঝতে পারে নি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে। সত্যি সূর্য জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত। পৃথিবী কোথায় যাবে, না যাবে, কি খাবে, না খাবে সবকিছু ওর মাথায়।
শুক্রবার রিকশা পাওয়া খুব ঝামেলা হয়ে যায়। তখন মনে হয় গাড়িটা আসলে প্রয়োজন। কিন্তু অন্য সময়ে গাড়ি ওকে টানে না। খোলা আকাশ দেখতে দেখতে বাতাসের পরশে অল্প একটু দুরত্বের অফিস ওর হাতের নাগালে। কিন্তু শুক্রবার আসলেই কেন যেন মনের অজান্তেই ওর গাড়ির নেশা জন্মে। সারা সপ্তাহে বুনোপাখির বারান্দা থেকেই রিকশা ডাকা যায়। কিন্তু শুক্রবারে গেট খুলে বাইরে এলেও রিকশার দেখা মেলা ভার। সূর্যের বন্ধু চাঁদ সেদিন বলছিল স্ক্রুটি এনেছে একটা পৃথিবীর জন্য
চলে আসুন সো রুমে। চালিয়ে চলে যাবেন।
পৃথিবী বলেছিল- প্রথমত আমি চাই না। দ্বিতীয়ত আমি চাই না এবং তৃতীয়ত আমি চাই না। হা হা হা
মনে মনে ভেবেছিল ওর সোনার বরণ রং যে ফেড হয়ে যাবে। টকটকে সূর্যের গলুনি ও কিভাবে রোধ করবে? ভর দুপুরে রিকশায় হুড ছাড়া ওঠে না এক মুহূর্ত। শুধু বৃষ্টি এলে হুডহীন রিকশা চায় পৃথিবী। হুড বৃষ্টিকে ছোবার অন্তরায়। ও বৃষ্টি চায়। বৃষ্টি...
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। না মেঘ নেই আকাশে। ফোন বেজে চলে অবিরাম
হ্যালো...সূর্য।
হু। বাইরে নাকি? শব্দ কিসের?
হু। বাইরে। গেটে।
কোথায় যাবে? বের হয়েছো কেন? আজ শুক্রবার।
গল্প খুঁজতে। গল্প খুঁজতে যাচ্ছি। আমি জানি তো! ওকে। ও ফোনের সুইচ অফ করে দেয়।
সি.সি.টি.এস অডিটোরিয়াম ।
তার আগেও কয়েক বার মঈনুলের আন্তরিক ফোন পেয়েছে।
কই আপনি?
এই এসে গেলাম।
আসুন।
ন' টা তো বেজে গেল। এক মিনিট দেরি হয় না আমাদের। যথা সময়ে শুরু হয়ে যায়।
একেবারে নীচের মূল রাস্তা থেকে শুরু করে প্রতিটি সিঁড়িতে সারিবদ্ধ মেয়েদের আন্তরিক অভ্যর্থনাসহ কেটে রাখা প্রবেশ কার্ড, রেখে দেওয়া সামনের এক নম্বর সীটসহ পুরোপুরি আতিথ্য সত্যি মন ছুঁয়ে যায় পৃথিবীর। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। পাঁচ শত মানুষ উপস্থিত অথচ পিন পতন নীরবতার এক স্বর্গীয় শান্তির সুবাতাস হলময়। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন আধা ঘন্টার মেডিটেশানে যার যার মনের বাড়িতে ঢুকেছিল, তখন এক মহাকাব্যিক আবেশ কেমন যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওদেরকে।
'আমি এক অনন্য মানুষ। আমরা এক মহান জাতি।'
এই শ্লোগানে সবাই বিমোহিত। আমিও তাই পারি যা অন্য কেহ পারেন। আমার মধ্যেও আছে এমন এক মহান শক্তি যা সহজেই আমরা মহান এক কাজে সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে পারি। সুস্থ দেহে প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন।
দান, দোয়া, ধ্যান-- এই তিনের সমাহারে আমরাই অনন্য। একটি নির্ধারিত বক্তৃতা, একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ এবং প্রথম মেডিটেশান শেষে পনেরো মিনিটের একটি বিরতি ।
পনেরো মিনিটের ভিডিও ক্লীপে বান্দরবানের লামাতে ‘ভ্যালি হিকমান’ পাহাড় জুড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজ শিক্ষার্থীদের নানা রকম অর্জন ছিল সত্যি অনিন্দ্য সুন্দর। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের কোয়ান্টাদের নানামুখী পারঙ্গমতা পৃথিবীকে আপ্লুত করে। পড়াশোনার পাশাপাশি নানা রকম কো-কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত ডিবেটস, জিমন্যাস্টিক্স, বিভিন্ন রকম স্পোর্স এ জাতীয় অর্জন এবং সরাসরি শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহণ সত্যি বাংলাদেশের জন্য আশা জাগানিয়া দৃশ্য। সকলের সহযোগিতায় পরিচালিত পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলটি সকলের মধ্যে অনন্য।
মাইকে মৃদু অথচ দৃঢ় উচ্চারণ--
গুরুজীর পক্ষ থেকে সকলের জন্যই একটু হালকা নাস্তার আয়োজন আছে। পৃথিবী বাস্তবে ফিরে আসে যেন।
সারি বেঁধে নাস্তা নেওয়া, ওয়াসরুম ইউজ করা, যার যার বিস্কিটের খালি প্যাকেট বিশেষ বালতিতে রাখা-- অন্য এক বাংলাদেশ যেন।
এক ফাঁকে পায়ে পায়ে অভ্যর্থনা টেবিলে বন্ধু মইনুলের সাথে দেখা করতে গেল পৃথিবী। শুধু দেখা নয় একটু কৃতজ্ঞতা জানানো। বন্ধু মইনুলের হাসিমুখ বলে দেয় সেও খুশি!
নাস্তা খেয়েছেন?
হু।
ওয়াসরুম চিনতে পেরেছেন?
হু।
ঠিক আছে। ভেতরে যেয়ে বসুন। এখানে গরম। ঘেমে যাচ্ছেন।
হু। যাচ্ছি।
আর কোনও কথা হয় নি দুজনার। ও টুকুই।
এখানে গরম এই কথা টুকুর আন্তরিকতা কতখানি গভীর সেটা ভাবতে ভাবতেই পৃথিবী অডিটোরিয়ামে ঢুকে ওর নির্ধারিত প্রথম সারির প্রথম সীটে বসে। যেটি মইনুল ওর জন্য সংরক্ষিত রেখেছে। বন্ধু মইনুলের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনায় কোয়ান্টাম ফাউ-েশনের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়। 'সাদাকায়ন' এর ওপর আলোচনা এবং চল্লিশ মিনিটের মেডিটেশান শেষে যখন পৃথিবী নতুন এক পৃথিবী হয়ে কোটি কোটি বছরের পুরনো পৃথিবীতে জেগে উঠলো, তখন ও অন্য এক পৃথবীর নতুন পৃথিবী।
বন্ধু মইনুলকে তখন আর শুধু রক্ত মাংসের মানুষ মনে হয় না। ওর অন্য গ্রহের অন্য কিছু মনে হয়। ওর ওপর জমানো এতদিনের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ঝরে ঝরে পড়ে মনের বাড়িতে ঝরনার ঝিকিমিকি শব্দ তুলে ঝরে পড়বার মতো বারবার। অবিরাম। ধ্যান আসলে মানুষকে অন্য এক পর্যায়ে উন্নীত করে। যুগে যুগে মহামানবেরা প্রত্যেকেই ধ্যানস্থ হয়েছেন। পর্যায় থেকে পর্যায়ে উত্তরণের মাধ্যমে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছেছেন। যার শুরুটা হয়তো এরকম আকর্ষিক এবং সাদামাটা ছিল। হেরা গুহা মানুষের হৃদয়ে পোক্ত আসন গেড়ে বসে আছে। যখন মহানবী সা. এর পয়ত্রিশ বছর বয়স তখন থেকে নবুয়ত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত ধ্যানস্থ হতেন তিনি। নবুয়্যত প্রাপ্তির পর অবশ্য তিনি আর কখনও হেরা গুহায় ধ্যানস্থ হতে যান নি।
পৃিথবীর মনের মধ্যে তখন এক প্রসারিত আকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত সূর্য, নির্মল পৃথিবী। যেখানে হানাহানি নেই, মারামারি নেই। নিয়তই প্রাপ্তির হিসেব নেই। ক্ষমতার লোভ নেই। শুধুই বিলিয়ে দাও। বিলিয়ে দেওয়া। ভোগে সুখ নেই। ত্যাগের শান্তি।
শান্তির সুবাতাস চারিদিকে। ঝিরঝির ঝরনার গান শুধু। এক অন্য রকম ভাললাগা। নিজের জন্য কিছু নয়। শুধুই বিলিয়ে দেওয়াা অপরের লাগি!
ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা একটা ছুঁই ছুঁই। কোয়ান্টাম মেথডের ধ্যান শেষে পৃথিবী জেগে ওঠে অন্য এক মানুষ হয়ে। ওর আর তখন গল্প খুঁজতে ভাল লাগে না। অথচ ও বেরিয়েছিল গল্প খুঁজতে!। কি এক প্রশান্তিতে ভরে থাকে মন। ছোট ছোট কদমে ও বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ওর পায়ের সাথে পা মিলিয়ে পাশাপাশি তেমনই হেঁটে আসে মইনুল। ওকে যত্ন করে একটা অটো রিকশা ডেকে দেয়।
আমাকে এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকতে হবে। ধরে বসবেন রিকশা।
ভাল থাকবেন।
বিদায়।
দূরের কোনও মসজিদ থেকে জুমার মিষ্টি আযান ওর কানে ভেসে আসে। অভ্যাস বসত ও শাড়ির আঁচল টানতে চায় মাথায়। কিন্তু ও অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ওর মাথা আগে থেকেই অসংখ্য সুদৃশ্য পাথরের পিনক্লীপে ঘিয়ে রং হিজাবে ঢাকা। ততক্ষণে রিকশা বাড়ির পথে চলতে শুরু করেছে। ওর আর গল্প খোঁজা হয় না। কিন্তু তারপরও কিছু একটা খুঁজে পাবার আনন্দে ওর মনা কেমন বিভোর।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/আগস্ট ৩০,২০১৯)