এক ল্যাপটপেই কোটিপতি ইসি’র অফিস সহায়ক জয়নাল!
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: তিন কক্ষের একটি মাটির ঘর। ওপরে টিনের চাল, চারপাশে মাটির দেয়াল। দুই বছর আগে তিন কক্ষের এই ঘরে থাকতেন চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিন ও তার পরিবার। কিন্তু দুই বছর পার না হতেই জয়নাল আবেদিন এখন কোটিপতি!
বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ আসকরিয়াপাড়ায় তিন গন্ডা (১ গন্ডা সমান ১.৯৮ শতাংশ) জায়গা কিনে সেখানে গড়ে তুলছেন পাঁচ তলা ভবন। ছোট ভাই জসিম উদ্দিনের নামে কেনা হয়েছে আরও সাড়ে তিন গন্ডা জায়গা। অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে জয়নাল এই বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। তবে তার পরিবারের দাবি, ওমান প্রবাসী ভাইয়ের উপার্জনে তাদের এই বিত্তবৈভব।
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে জয়নাল আবেদিনকে পুলিশে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের একটি ল্যাপটপ চুরি করে ওই ল্যাপটপের মাধ্যমে জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতেন বলে জানিয়েছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন।
২০১৭ সালের পর থেকে জয়নালের পরিবারে সচ্ছলতা আসতে শুরু করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৭০ বছর বয়সী জয়নালের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘তার বাপ-দাদারা সবাই জেলে ছিলেন। তিন চার বছর আগেও জয়নালের বাবা মাছ ধরার কাজ করতেন। কিন্তু এখন আর তা করেন না। এখন তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পৌরসভার দক্ষিণ আসকরিয়া পাড়ায় জায়গা কিনে পাঁচ তলা একটি ভবন নির্মাণ করছেন তারা। সাত-আট মাস আগে নতুন বাড়ি থেকে একটু সামনে আরও তিন গন্ডা জায়গা কিনেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছর আগে যেখানে শরিকে কোরবানি দিতেন, সেখানে এবার এক লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একা একটি গরু কোরবানি দিয়েছেন। এই বছর হজ করে এসেছেন তার মা-বাবা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন ভাই বোনের মধ্যে জয়নাল আবেদিন সবার বড়। আর্থিক অনটনের কারণে জয়নাল খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর আর পড়ালেখা সম্ভব হয়নি। ২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে চাকরি নেন। ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে। তার স্বামীও নির্বাচন কমিশনে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। ওই ছোট বোনও তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি। ছোট ভাই জসিম উদ্দিনও এক সময় বাবুর্চির কাজ করতেন এবং বর্তমানে ওমান থাকেন।
২০০৪ সালে তার মামা তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিব স ম জাকারিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অফিসে অফিস সহায়ক (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) হিসেবে যোগদান করেন জয়নাল আবেদিন। দীর্ঘদিন রাঙামাটি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কাজ করার পর ২০১৭ সালের দিকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, এরপরই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু করেন। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয়দের ধারণা ওই টাকা দিয়েই জয়নাল নিজ এলাকায় জায়গা কেনাসহ পাঁচ তলা ভবন তৈরি করছেন।
মোস্তফা আলী নামে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জয়নালের পরিবার চলতো। কোনোমতে দিনে এনে দিনে খেতো। কিন্তু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকেই তাদের পরিবারের ভাগ্য খুলতে শুরু করে। ৬/৭ মাসের ব্যবধানে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে দুই খণ্ড জমি কিনে ফেলে। এর মধ্যে পৌরসভার দক্ষিণ আসকরিয়াপাড়া এলাকায় নির্মাণ করছে পাঁচ তলা ভবন। ছয় মাস আগে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া ওই ভবনের তিন তলার কাজ শেষ ইতোমধ্যে চার তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।’
বাঁশখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘জয়নাল আবেদিনের বাবা মোনাফ মাঝি খুবই গরিব ছিল। ২০ বছর আগে তিন কড়া জমির ওপর শুধু একটি মাটির বসত ঘর ছিল। এখন তাদের অনেক টাকা পয়সা। এলাকার লোকজন বলাবলি করে, জয়নাল রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এসব টাকা কামিয়েছেন। আসকরিয়াপাড়ায় নতুন বাড়ি তৈরি করতেছে। পাঁচ মাসে পাঁচ তলা ভবনের চার তলা পর্যন্ত ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ব্যাংকেও নাকি প্রচুর টাকা আছে।’
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জয়নালের মা দিলদার বেগম বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে ওমান থাকে। তার টাকায় ওই বিল্ডিং তৈরি করছি। ছোট ছেলের ওমানে দোকান আছে, সেই টাকাগুলো পাঠিয়েছে।’ জসিমের নামে সাড়ে তিন গন্ডা জায়গা কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জায়গাটা আমার ভাই আমাকে দিয়েছে। ওদের বাবা এটা জসিমের নামে রেজিস্ট্রি করেছেন।’
ছোট ছেলের নামে জায়গা থাকার পরও জসিম কেন জয়নালের নামে থাকা জায়গায় ভবন নির্মাণ করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই জায়গাটা রাস্তা থেকে একটু দূরে। তাই আমার ছোট ছেলে বলেছে ওখানে বাড়ি না করে এই জায়গায় বাড়ি করে দুই ভাই একসঙ্গে থাকবে। তাই দুই ভাই মিলে বাড়িটি করছে।’
জায়গা কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের থাকার জায়গা নেই। তাই ঘর করার জন্য জায়গা কিনতে হয়েছে। পুরনো বাড়িতে টিনের চাল, আর চারপাশে মাটির দেয়াল থাকা ছোট একটা ঘর আছে।’
জয়নালের ছোট ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমার ওমানে দোকান আছে। আমি ওই দোকানের ইনকাম দিয়ে জায়গা কিনেছি। পাঁচ তলা এই বিল্ডিং তৈরি করছি। আমি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। আপনারা চাইলে আমার ব্যাংক হিসাব চেক করে দেখতে পারবেন।’
জয়নাল সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খুব বেশি তথ্য জানাতে পারেননি। ২০১৭ সালে জয়নাল রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম বদলি হয়ে আসেন বলে তিনি জানান।
তবে নির্বাচন কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগে এর আগেও জয়নাল শাস্তি পেয়েছিলেন। রাঙামাটিতে কাজ করার সময় এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। ওই মামলায় শাস্তি হিসেবে ২০১৬ সালে তার তিন বছরের ইনক্রিমেন্ট বাতিল করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ১৮,২০১৯)