উপাচার্য হিসেবে তারা কতটা সফল?
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বাংলাদেশে প্রথম সারির সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের (ভিসি) কার্যকলাপ সমালোচনার মুখে পড়েছে। অফিস না করা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনকে সবসময় বাড়তি সুবিধা দেওয়া, পারিবারিক সুবিধা গ্রহণ থেকে শুরু করে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়ানোর অভিযোগ উঠছে তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে।
বেশিরভাগ সময় বিষয়গুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের হজম করতে বাধ্য করলেও পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে গেলেই ইস্যুগুলো নিয়ে তারা পড়ছেন তোপের মুখে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের পাশাপাশি উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ, এর পরিবর্তন জরুরি।
একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বেশ কয়েকজন উপাচার্যকে নানাভাবে সরে যেতে হয়েছে গত একবছরে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এসএম ইমামুল হক ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন, একইভাবে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান নানা অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বাধা দিয়েছিলেন এবং পদে থাকাকালীন তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেও দেননি।
কেন এই উপাচার্যরা ক্ষমতাকে এভাবে ব্যবহার করেন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগে সমস্যা রয়ে গেছে। ভিসি নিয়োগে সরকারকে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে ছাত্রলীগকে কোটি টাকা ঈদ বকশিশ দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে সেপ্টেম্বরের শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম নিজেই সমালোচনার মুখে পড়েন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতা শোভন-রাব্বানী পদ হারালেও এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি উপাচার্য ফারজানার বিরুদ্ধে। যদিও শিক্ষার্থীদের দাবি, বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি করেছেন তিনি। ওই ঘটনার পর থেকে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা উপাচার্যের নানা অন্যায় পদক্ষেপ নিয়ে ফোনালাপ ফাঁস করেছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমে সমালোচনার মুখে আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নানা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে একের পর এক বহিষ্কার করা, বহিষ্কারের আগে অভিভাবকদের ডেকে হেনস্তা করা, শিক্ষার্থীদের গালিগালাজ করার মধ্য দিয়ে তিনি ক্যাম্পাসে বহু আগে থেকেই ছিলেন সমালোচনার কেন্দ্রে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সর্বশেষ এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করাকে কেন্দ্র করে তার একাধিক আলাপের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে−ভিসির মুখে এ কোন ভাষা! শুধু গালিগালাজই নয়, গত একবছরে ২৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে চলে আসার পর উপাচার্য পদে তার পেশাদারিত্বের বিষয়টিই এখন আছে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার থেকে তার পদত্যাগ চেয়ে টানা আন্দোলন ও অনশন করছেন।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ’র বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ উপাচার্য হয়েও ক্যাম্পাসে না থেকে ঢাকায় বসবাস করার। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে বহু সমালোচনা ও লেখালেখি হলেও কোনও কিছুই পাত্তা দেন না তিনি। নিজে ঢাকায় বসে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকারও ঢাকায় করে এবং তার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের কাজে বিশ্ববিদ্যালয়টির গাড়ি ব্যবহার করে তুমুল সমালোচিত হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রথম ৩৪০ দিনের কর্মকালে তিনি কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৯০ দিন; অর্থাৎ ৩৪০ দিনের চাকরিতে ২৫০ দিনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। এরমধ্যে কিছুদিন হয়তো ছুটিতেও ছিলেন। গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড়ের পরেও তার গায়ে কোনও আঁচ লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের ভাষ্য, উপাচার্য বেশিরভাগ সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন না। এটি নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে কথা বলার কোনও পরিস্থিতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে তিনি কিছু বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন, তার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ করেন অনুগত ও প্রভাবশালী এসব শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি বড় কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে বিরতি দিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২৮ বছর পরে ডাকসু ঘোষণা করলেও নানা কারণেই এখন তিনি আলোচিত-সমালোচিত। বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা তার অফিস ঘেরাও করলে তিনি সরাসরি সমাধান করার চেষ্টা না করে ঘুরিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সহযোগিতা নিয়েছেন। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা নিয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠেছে সবকটিতেও তিনি তদন্তের কথা বলে পরিস্থিতি ধামাচাপা দিয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহানের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৪৭৫তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা শিথিল করা হয়। আগে শিক্ষক নিয়োগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রার্থীর ন্যূনতম যোগ্যতা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ এবং একাডেমিক ফল প্রথম সাতজনের মধ্যে থাকতে হতো। পরে শিথিল করা হলে অভিযোগ করা হয় তিনি তার মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক বানাতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সে সময় প্রশাসনের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষক মারুফুল ইসলাম মনে করেন, ৭৩ অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট এবং সিনেট থেকে নির্বাচিত প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের যে নিয়ম সেটি যথাযথ। শুরুর চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো এই নিয়ম মানে না, সরাসরি তাদের নিয়োগ হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা থাকে না। তবে দুইটা নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই নিয়ম সমস্যা না, যারা নিয়ম ব্যবহার করছেন তারা যদি তা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে আমরা উপকার পাবো না। পদ্ধতিগত কী সংস্কার করা যায় প্রশ্নে তিনি বলেন, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি করা যেতে পারে, তারা এটি নিয়েই কাজ করবেন এবং কোন বিবেচনায় সম্ভাব্য উপাচার্যের তালিকা করছেন সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। এতে করে একধরনের অংশগ্রহণমূলক হবে প্রক্রিয়াটি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে সেসব নিয়ে ক্ষুব্ধ বোধ করছেন এবং একইসঙ্গে লজ্জা পাচ্ছেন উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সেই কত বছর থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগে কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা কেউ করেন না, এই নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় এবং কারোর প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকার কারণ নেই। তারা পদটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চান এবং রাজনৈতিভাবে নিয়োগ পাওয়ায় তারা নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করেন।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ২৩,২০১৯)