দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রাজধানীতে ক্যাসিনো-জুয়া খেলা হয় এমন দেড় শতাধিক স্পটের তালিকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) টেবিলে। ডিএমপির ৮টি অপরাধ বিভাগ এবং ৪টি গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ তালিকা করা হয়েছে। তালিকা ধরে ধরে অভিযান চলছে।

চলমান অভিযানের মুখে এসব ক্লাবের অধিকাংশই বন্ধ। আর যাতে চালু না হয় সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবৈধ অনেক ক্যাসিনোর বিষয়ে আগে থেকেই জানত পুলিশ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ বিষয়ে এতদিন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এদিকে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তে আগ্রহ নেই ডিবি পুলিশের। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হল অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর মামলা হয়নি। মাদক ও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার এসব নেতা ক্যাসিনোর বিষয়ে পুলিশকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। ক্যাসিনোর সঙ্গে পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশ পাওয়া গেছে।

ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার নামও বেরিয়ে এসেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হলে ওইসব নেতা ও বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তার নাম চলে আসবে।

বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেখানে ক্যাসিনো গডফাদারদের সুসম্পর্ক সেখানে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষে স্বাধীন তদন্ত করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ অবস্থায় রীতিমতো বিব্রত তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তাই মামলাগুলোর তদন্তভার র‌্যাবে যাচ্ছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

এদিকে অবৈধ জুয়া-ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে বুধবার থেকে শুরু হওয়া অভিযানে র‌্যাবের হাতে এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ২১৫ জন। এদের মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে ২০১ জনকে।

যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজসহ ১৩ জন রিমান্ডে আছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সোমবার তার কার্যালয়ে বলেন, যেসব জায়গায় ক্যাসিনো এবং বড় বড় জুয়ার আড্ডা চলে সেসব জায়গার তালিকা এরই মধ্যে হাতে পেয়েছি। তালিকা বেশ লম্বা, দেড় শতাধিক।

চলমান অভিযানের মুখে এখন সব আস্তানার ক্যাসিনো-জুয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ক্যাসিনোর বিষয়ে এ পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো ডিএমপি তদন্ত করবে না। সেগুলোর তদন্ত করবে র‌্যাব। ইতিমধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ সাবেক যেসব কর্মকর্তার পকেটে গেছে তাদের বিষয়ে হয়তো তেমন কিছু করতে পারব না। তবে যারা এখনও পুলিশের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তাদের বিষয়ে ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশনের (আইএডি) মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আইএডি শাখায় বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং গ্রেফতারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ শাখার সদস্যরা রিপোর্ট পেশ করবেন।

তার ভিত্তিতেই জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলা হবে।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, ক্যাসিনোসংক্রান্ত অভিযানের যে কোনো মামলার তদন্তভার আমাদের ওপর অর্পিত হলে আমরা তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত।

এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব বদ্ধপরিকর। যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে আপনাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে আমাদের সহযোগিতা করতে পারেন।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতররা নানা ধরনের তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যুবলীগ নেতা ও ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ জিজ্ঞাসাবাদে জানান পুলিশের বর্তমান ও সাবেক পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তিনি ক্যাসিনো ব্যবসা করতেন।

তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ক্যাসিনো চলাকালে অনেক সময় থানা পুলিশের সদস্যরাও নিরাপত্তা দিয়েছেন।

যুবলীগের অপর নেতা জি কে শামীম ক্ষমতাসীন দলের কোন নেতাকে কত টাকা দিয়েছেন, সাবেক মন্ত্রীসহ বর্তমান ও সাবেক প্রকৌশলীকে টাকা না মার্কিন ডলার দিয়েছেন- সে বিষয়ে সব বলে দিয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের নাম বেরিয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা শঙ্কিত। যাদের নাম আসছে তাদের নামে রিপোর্ট দিতে পারবেন কিনা, দিলে কী হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবছেন।

বিষয়গুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চাচ্ছেন না তদন্ত করতে। এ অবস্থায় তদন্ত কাজ র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে ঢাকায় দেড় শতাধিক স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বসে। তালিকাটি আছে ডিএমপি কমিশনারের কাছে। তিনি স্পটের নামগুলো জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে অন্য একটি সূত্র থেকে বেশকিছু স্পটের নাম জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে আছে- আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, সোনালী অতীত ক্রীড়াচক্র, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ব্রাদার্স ক্লাব, মেরিনার্স ক্লাব, মিরপুরে ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন ক্লাব, দুয়ারীপাড়া ক্লাব, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত গাজীপুর, কারওয়ান বাজারের প্রগতিসংঘ ক্লাব, ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, ধানমণ্ডি ক্লাব, মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় সৈনিক ক্লাব, উত্তরা র‌্যাব-১ এর বিপরীত পাশে উত্তরা ক্লাব, এলিফ্যান্ড রোডের এজাক্স ক্লাব এবং পুরানা পল্টনের জামাল টাওয়ার, মহাখালীর একাদশী ক্লাব।

সব জানত পুলিশ : রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়ে ২০১৭ সালের ৮ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয়েছিল।

কিন্তু তখন কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের নাকের ডগাতেই ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসার বিকাশ ঘটেছে। এ ব্যবসা সম্পর্কে পুলিশ সব জানত।

মতিঝিল থানা থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরত্বের মধ্যে ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া চক্র এবং দিলকুশা ক্লাব। অথচ এসব ক্লাবে বছরের পর বছর ধরে ক্যাসিনো ব্যবসা চললেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে মূলধারার ক্লাবগুলোতে গত কয়েক বছর ধরে খেলাধুলা নয়, ক্যাসিনো ব্যবসাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, জুয়া, মাদক, অস্ত্রসহ এ ধরনের যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অপারেশনাল ইউনিটগুলোর প্রতি নির্দেশনা রয়েছে।

এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বা তাদের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুই বছর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে এক ব্যক্তি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়ে একটি অভিযোগ দেন।

ওই অভিযোগে তিনি বলেন, রাজধানীতে একটি অসাধু চক্র দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, গুলশানের ফু-ওয়াং ক্লাব, ধানমণ্ডিতে কলাবাগান ক্লাব, ধানমণ্ডি ক্লাব, মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় সৈনিক ক্লাব, উত্তরা র‌্যাব-১ এর বিপরীত পাশে উত্তরা ক্লাব, এজাক্স ক্লাব এবং পুরানা পল্টনের জামাল টাওয়ারে ক্যাসিনোর ব্যবসা করছে।

পাশাপাশি মাদক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ৮ জুন পুলিশ সদর দফতরে একটি চিঠি পাঠায়। সেই চিঠিতে বলা হয়, অভিযোগের বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথমে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনোর ব্যবসা শুরু হলেও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায়।

যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রছায়ায় এগুলো চললেও নিয়মিত টাকার ভাগ চলে যেত অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়টি পুলিশের সব ইউনিট জানত। পুলিশ বিভিন্ন সময় ক্যাসিনোতে অভিযানেও গেছে। সকালে অভিযানে গিয়ে তালা মেরে এলেও বিকালে আবার বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে।

এভাবেই ক্যাসিনো আবার চালু হয়ে যেত। ক্যাসিনো বন্ধে পুলিশের কোনো ইউনিটই আগ্রহী ছিল না।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, যুবলীগ নেতা খালেদ ও জি কে শামীমের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর তদন্তে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন- ক্যাসিনো তো বন্ধ হবেই, পাশাপাশি সিসা বারও বন্ধ হবে। কারণ সিসা বারে এখন মাদক খাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় হেলথ ক্লাব বা স্পার নামে অবৈধ নারী ব্যবসা হচ্ছে- এগুলো পুরোপুরি বন্ধ হবে।

ডিজে পার্টির নামে উলঙ্গ নাচ থাকবে না। চলমান অভিযানের মুখে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট লাপাত্তা। তিনি কী দেশে আছেন না কি বিদেশে পালিয়ে গেছেন?

তাকে ধরতে ডিএমপির কোনো উদ্যোগ রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ বিষয়টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র‌্যাবকে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ২৪,২০১৯)