আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের পরিণতি
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিকশিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ইতিহাস একটি পর্যায়ে গিয়ে একাকার হয়ে যায়।
বাংলাদেশের মানুষের জাগরণ, ভাষার আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। জাতির পিতার এই সংগঠনটি জনগনের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। জনগনের শক্তিতে বিশ্বাস করে। সর্বস্তরের জনগনই আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তি। আওয়ামী লীগকে কখনো ক্যাডার রাজনীতির ওপর নির্ভর করতে হয়নি। ক্যাডার রাজনীতিকে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
তারপরও বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগে কিছু কিছু ক্যাডারের উত্থান হয়েছে। তাদের পরিণতি হয়েছে অত্যন্ত করুণ। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে ক্যাডার রাজনীতির কোন অস্তীত্বই দেখা যায়নি। বরং লাখো জনতার উত্তাল জনস্রোতই ছিল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন গঠিত হয় তখন আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্যাডার রাজনীতির চর্চা শুরু হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, সেই সময় জাসদের গণবাহিনী এবং জাসদের হত্যাযজ্ঞ, সরবরাহদের বিস্তার ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী লীগের মধ্যেও অস্ত্রধারী ক্যাডারদের উদ্ভব ঘটে।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রথম আলোচিত ক্যাডারের নাম শফিউল আলম প্রধান। তিনি সেই সময় ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার হাত ধরেই সাতখুনের ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে ঘটনা আওয়ামী লীগকে কলংকিত করেছে। শফিউল আলম প্রধান পরবর্তীতে আর আওয়ামী লীগে থাকেননি। তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল এক রাজনীতির ধারায় গা ভাসিয়েছেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নি:শেষ করে দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান যা যা করা দরকার তাই তাই করেছিলেন। লাখ লাখ নেতাকর্মীকে জেলে বন্দি করেছিলেন। এই সময় আওয়ামী লীগ নামে সংগঠনের অস্তীত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিল দুরহ। জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন পুনর্গঠিত হয়, সে সময় আওয়ামী লীগের অস্বীত্বের কারণেই প্রথমবারের মতো দলীয় আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়। সে সময় আওয়ামী লীগে বেশকিছু ক্যাডারের উদ্ভব ঘটে। এই সমস্ত ক্যাডাররা অনেক সময় আওয়ামী লীগের ওপর যে আঘাত সেই আঘাতের পাল্টা আঘাত করার জন্য ব্যবহৃত হতেন। অনেক সময় ক্যাডাররা রাজনীতিবিদদের জন্য মাঠ তৈরী করার কাজও করতেন। এই সময় ক্যাডারদের মধ্যে আলোচিত ছিলেন কে এম হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ এক সময় ঢাকা শহরের নামকড়া ক্যাডার ছিলেন। তার নিজস্ব বাহিনী ছিল। কিন্তু হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থাকতে পারেননি। ২০০৭ সালে বিএনপিতে যোগ দেন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদও পেয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির সঙ্গেই ছিলেন। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ।
পঁচাত্তর পরবর্তী আরেক আলোচিত ক্যাডার হলেন লিয়াকত হোসেন। তিনিও একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য জরুরি ক্যাডার ছিলেন। কারণ সে সময় আওয়ামী লীগ কোথাও জনসভা করতে পারতেন না। জিয়াউর রহমানের ক্যাডার বাহিনী তখন আওয়ামী লীগ জনসভা করলেই হামলা করতো, ভাঙচুর করতো। সেই সময় লিয়াকতদের উন্মেষ ঘটে। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ এমন পরিকাঠামোতে গড়া , ক্যাডাররা এখানে টিকতে পারে না। এক সময় লিয়াকতকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর লিয়াকতের করুণ মৃত্যু ঘটে। এক-এগারোর সময় র্যাব তুলে নিয়ে যায় লিয়াকত হোসেনকে। এরপর আর হদিস মেলেনি তার। আলোচিত আরেক ক্যাডার মুশফিকুর রহমান খান হান্নান। পঁচাত্তর পরবর্তীতে তিনিও আলোচিত ক্যাডার। যার উত্থান ঘটেছিল আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় তিনি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আশির দশকে আওয়ামী লীগের আলোচিত ক্যাডার ছিলেন মোস্তফা মহসীন মন্টু। তার হাত ধরেই ঢাকায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ধরনের ক্যাডার এবং সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। আশির দশকের শেষদিকে মনিরুজ্জামান বাদলের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে মোস্তফা মহসীন মন্টুকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। তিনি আওয়ামী লীগের শেষ তারকা ক্যাডার।
তবে পঁচাত্তরের পরবর্তীতে রাজনীতিতে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজ এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং চিহ্নিত অপরাধীদের অনুপ্রবেশ ঘটার প্রেক্ষিতে ভারসাম্যের রাজনীতির জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও অনেক ক্যাডারের অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু কোন ক্যাডারদেরই সুস্থ পরিণতি হয়নি। এক সময় ফেনীর আলোচিত ক্যাডার ছিলেন জয়নাল হাজারি। সেই জয়নাল হাজারিও আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন। এক সময় লক্ষীপুরের আলোচিত ক্যাডার ছিলেন আবু তাহের। তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ডানা মেলতে পারেননি।
সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগে আরো কিছু ক্যাডার তৈরী হচ্ছিল। যাদের মধ্যে রয়েছেন খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, ইসমাইল চৌধুরি সম্রাটসহ আরো অনেকে। এবার শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হয়তো ক্যাডার রাজনীতির চির অবসান ঘটাতে যাচ্ছে। কারণ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগের যে রাজনীতি তার সঙ্গে ক্যাডার সংস্কৃতি কখনোই যায় না। জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে যে শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন তার অবসান ঘটাচ্ছেন শেখ হাসিনা।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ২৭,২০১৯)