দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে চলা অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর সব থেকে বেশি আলোচিত হচ্ছে একটি নাম। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তিনি হচ্ছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি।

মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল এলাকায় ক্লাব-হোটেলগুলোয় ক্যাসিনো ব্যবসার মুকুটহীন সম্রাটও বলা হয় তাকে। রাজধানীর এসব এলাকার ক্লাবে যাতায়াতাকারীদের কাছে তিনি ক্যাসিনো সম্রাট হিসেবেই পরিচিত।

ক্যাসিনো সম্রাটকে গ্রেফতারের গুঞ্জন জোরালো হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারেন যুবলীগের এই প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু তার গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়ায় অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, অধরাই থেকে যাচ্ছেন ক্যাসিনো সম্রাট। কিন্তু সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, সম্রাট গ্রেফতার এড়াতে নানা ফন্দিফিকির করলেও তার রেহাই নেই। তার গ্রেফতার নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন ও গুজব। তবে সম্রাটকে নিয়ে এই গুঞ্জন ও গুজবের নতুন মাত্রা পেয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়।

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে যে, সম্রাটকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো একটি ইউনিট। তাকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলেও জোরালো গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

আবার বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা সম্রাটকে কোনো একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আটক করেছে। তাকে ক্যাসিনো ব্যবসার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হতে পারে।

এসব জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই রোববার সকাল থেকে রাজধানীতে ডিএমপি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ভিড় জমে। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের সর্বশেষ অবস্থার তথ্য জানতে মুখিয়ে আছেন সাংবাদিকরা। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।

এর আগে শনিবার সম্রাটের গ্রেফতারের বিষয়ে রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘দেখবেন, আপনারা শিগগিরই দেখবেন। আপনারা অনেক কিছু বলছেন, আমরা যেটি বলছি ‘সম্রাট’ হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাকে আমরা আইনের আওতায় আনব। 'আমি এটি এখনও বলছি, সম্রাট বলে কথা নয়; যে কেউ আইনের আওতায় আসবে। আপনারা সময় হলেই দেখবেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকেই সম্রাটের গ্রেফতারের গ্রিন সিগন্যাল পায় আইনশৃংখলা বাহিনী। এরপরই তাকে আটক করা হয় বলে জল্পনা শুরু হয়।

চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে যুবলীগের কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর সম্রাটের নাম আসতে থাকে গণমাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রতি রাতে ৪০ লাখ টাকা রাজধানীর ১৫টি ক্যাসিনো থেকে চাঁদা হিসেবে পেতেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট।

১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযানের পর ক্লাবটির মালিক যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। দুদিন পর গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের আরেক নেতা টেন্ডারবাজ হিসেবে পরিচিত জি কে শামীমকে। এরা দুজনই সম্রাটের ক্যাসিনো বাণিজ্যের অংশীদার।

১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোতে অভিযান শুরু করে র‌্যাব-পুলিশ। ওইদিনই ঢাকার মতিঝিলের ফকিরাপুল ইয়াংমেনস ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রে র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো মেলার পাশাপাশি সেগুলো পরিচালনায় যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়।

ওই দিনই গ্রেফতার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। পর দিন কলাবাগান ক্লাব থেকে গ্রেফতার করা হয় কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। দুদিন পর গ্রেফতার করা হয় ঠিকাদার জিকে শামীমকে, যিনিও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। এরা সবাই সম্রাটের অবৈধ ব্যবসার যোগানদাতা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া ও ফকিরেরপুল ইয়াংমেনস ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি। এর মধ্যে ইয়াংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সম্রাটের শিষ্য খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বাকি পাঁচটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন সম্রাটের লোকজন।

সম্রাটের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তারা এক বছর আগে পল্টনের প্রীতম–জামান টাওয়ারে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন। মমিনুল হক এখন সিঙ্গাপুরে।

সূত্রে জানা গেছে, অভিযানের শুরুর কয়েকদিন গতিবিধি পর্যালোচনা করেন যুবলীগ সভাপতি সম্রাট।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, জুয়া-ক্যাসিনোবিরোধী পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানের শুরুতে সম্রাট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

এ সময় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে কেউ স্পর্শ করবে না- এমন বিশ্বাস ছিল। উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপে রাখতে অভিযানের শুরুর দিকে তিনি দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাকরাইলে মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের কার্যালয়ে অবস্থান নেন।

কিন্তু অভিযানের গতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় তিনি ঘাবড়ে যান। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পর সম্রাট গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন।

যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, খালেদ ও জিকে শামীম গ্রেফতারের পর নড়ে বসেন সম্রাট। গ্রেফতার এড়াতে নানা মহলে লবিং শুরু করেন। যুবলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে চান যে, তাকে ছাড়া ঢাকায় যুবলীগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মতো কেউ নেই। এভাবে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই এসব করেন সম্রাট।

মাদকবিরোধী সরকারের কঠোর মনোভাবে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। শুরুতেই ঘন ঘন অবস্থানও পরিবর্তন করেন। যুবলীগের কার্যালয় থেকে ‘ছদ্মবেশ’ নিয়ে বেরিয়ে আসেন।

এর পর দুটি ঠিকানা বদলের পর তিনি নির্ভরযোগ্য স্থানে চলে যান।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, প্রভাবশালী বন্ধুরা কেউ তার ফোন না ধরায় সম্রাট বেকায়দায় পড়েছেন। অভিযান শুরুর পর থেকে দু-একজন ছাড়া অধিকাংশ প্রভাবশালী তাকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন। তার ফোনও ধরেন না।

কাজেই এ পরিস্থিতিতে কারও সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগও পাচ্ছিলেন না। এর পরও তিনি অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বর্তমান আস্তানায় চলে আসেন। সেখানে পৌঁছার পর ওই নেতা খুশি না হলেও তাকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন বলে জানায় সম্রাটের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে সম্রাটের ওপর নজরদারি শুরু করে।

যুবলীগ অফিস থেকে বের হওয়ার পর প্রথম দিকে তার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি থাকলেও গত কয়েক দিন একাই ঠিকানা বদল করেছেন।

প্রভাবশালী নেতার বাসায় তিনি একাই গেছেন। ঘনিষ্ঠ কাউকে কিছুই জানতে দেননি। এতকিছুর পরও তিনি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি।

বিশেষ করে তিন-চার দিন ধরে সম্রাটের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল একাধিক সংস্থার কাছে।

সম্রাট যখন বুঝতে পারেন অভিযানের এক পর্যায়ে তিনি ফেঁসে যেতে পারেন, তখন গ্রেফতার এড়াতে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের আড়ালে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করেন।

যদিও সম্রাট দেশ ত্যাগ করতে পারেন এমন আশঙ্কা আগে থেকেই আঁচ করেতে পেরেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই সম্রাটের দেশত্যাগের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি আদেশ দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে। তিনি যাতে পালাতে না পারেন, সে জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি জোরদার করা হয়। তার দেশ ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ২৯,২০১৯)