বিয়ের কথা বলে ছাত্রীকে মাসের পর মাস ‘পল্টন থানার ওসির ধর্ষণ’!
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: বিয়ের কথা বলে এক তরুণীর সঙ্গে প্রায় দেড় বছর ধরে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হক। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন মেয়েটি। এর পরই বিয়ের জন্য চাপ দেন মাহমুদুল হককে। বিয়ে করবেন, তবে অনাগত সন্তানকে নষ্ট করতে হবে, এমন প্রস্তাব দেন তরুণীকে। বিয়ের স্বপ্নে প্রস্তাবে রাজি হয়ে মেয়েটি ওষুধের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলেন গর্ভের সন্তান।
কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বিয়ে আর করেন না পল্টন থানার ওই কর্তা। একপর্যায়ে তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। মাহমুদুলকে বিয়ের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তরুণী। বিয়ের প্রলোভনে তার সঙ্গে ওসির অনৈতিক কার্যক্রমের বিস্তারিত তুলে ধরে এবং বিচারের দাবিতে গত ১ আগস্ট পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ওই তরুণী।
তদন্তে সে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে, জমা পড়েছে তদন্ত প্রতিবেদনও। এরপরও মাহমুদুল হক পল্টন থানার ওসি হিসেবে বহাল তবিয়তেই কাজ করে যাচ্ছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক সূত্র, মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী ওই তরুণীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আইজিপির কাছে দেওয়া তরুণীর লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ওসি মাহমুদুলের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। মেয়েটির বাড়িও উত্তরবঙ্গে। প্রথমে চাকরির কথা বলে তাকে ঢাকায় ডাকেন তিনি। ছোট বোন পরিচয়ে পল্টনের হোটেল ক্যাপিটেলে ওঠান মেয়েটিকে। খাবারের সঙ্গে নেশাজাতীয় কিছু খাইয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন ওসি। এ নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। ওসি তাকে আশ্বস্ত করেন, তাকে ভালোবাসেন তিনি। স্ত্রী থাকলেও বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর থেকে প্রায়ই ওই হোটেলের ৩১৫ ও ৫১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে লিপ্ত হয়েছেন শারীরিক সম্পর্কে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইজিপির কাছে তরুণীর দেওয়া অভিযোগটি তদন্ত করেন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোনালিসা বেগম। তদন্ত শেষ করে সম্প্রতি তিনি প্রতিবেদনটি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন।
গত বুধবার ডিএমপি থেকে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। দীর্ঘদিন তরুণীর সঙ্গে ওসি মাহমুদুলের অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের তথ্য উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। পল্টনের হোটেল ক্যাপিটেলে নিয়ে একাধিক দিন তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক এবং তরুণীর সঙ্গে ওসির কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরারও প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
হোটেল ক্যাপিটেলের ৩১৫ এবং ৫১৭ নম্বর কক্ষ প্রায় প্রতি মাসে এক বা একাধিক দিন ওসি পল্টনের নামে বুকিং দেওয়ার তথ্যও মিলেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ৩১৫ নম্বর কক্ষটি ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বুকিং দেন। সেটি চেকআউট হয় ২২ সেপ্টেম্বর। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ৫১৭ নম্বর কক্ষটি বুক করেন এবং চেকআউট হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। একই বছরের ৪ অক্টোবর ৫১৭ নম্বর কক্ষ বুক করেন। পরের দিনই সেটি চেকআউট করা হয়। এরপর ১৮ অক্টোবর ৩১৫ নম্বর কক্ষ বুক করেন এবং সেটি চেকআউট হয় ২২ অক্টোবর। ৬ ডিসেম্বর একই কক্ষ নেওয়া হয় এবং দু’দিন পর সেটি চেকআউট করা হয়।
চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি নেওয়া হয় একই কক্ষ এবং ১২ জানুয়ারি চেকআউট করা হয়। আবার ৫১৭ নম্বর বুকিং নেওয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২ মার্চ সেটি চেকআউট করা হয়। সর্বশেষ ১৪ মার্চ আবার ওই হোটেলের ৩১৫ নম্বর কক্ষ নেওয়া হয় ওসি পল্টনের নামে। ১৭ মার্চ চেকআউট করা হয় কক্ষটি।
ভুক্তভোগী তরুণী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি সরকারি একটি কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ওসি মাহমুদুল হক আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমাকে ঢাকায় ডেকে আনেন। আমাকে রাখার জন্য পল্টনের ক্যাপিটাল হোটেলের একটি রুমে নিয়ে যান। সেখানে হোটেল বয়কে দিয়ে আমার জন্য স্যুপ নিয়ে আসান। আমি খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ান। এরপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।’
ওই তরুণী বলেন, ঘুম ভাঙলে দেখি রাত ২টার মতো বাজে। ওই সময় মাহমুদুল হক আমার পাশেই শুয়ে ছিলেন। আমি বুঝতে পারি, ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয়েছি। মাহমুদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয় জানিয়ে তিনি আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন।
ওই তরুণীর অভিযোগ, এরপর প্রতি সপ্তাহেই ওই তরুণীকে ঢাকায় ডেকে এনে একই হোটেলে নিয়ে যেতেন মাহমুদুল হক। গত বছরের অক্টোবর মাসে তিনি বুঝতে পারেন, অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। এ কথা মাহমুদুল হককে জানালে তিনি ওই তরুণীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গর্ভপাত করতে বলেন এবং একপর্যায়ে তার কথায় রাজি হয়ে গর্ভপাত করান ওই তরুণী। তিনি জানান, দু’জনের সম্মতিতে তাদের মধ্যেকার শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ও ছবিও ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো ওই তরুণীর কাছে রয়েছে।
ওই তরুণী বলেন, মাহমুদুল হক বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও আমাকে বিয়ে করেননি। সবশেষ গত ২ এপ্রিল আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করেন দেন। আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছি এসময়। পরে আমার পরিবার সবকিছু জানতে পারলে তারা মাহমুদুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এসময় আমার পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়, পল্টন থানার ওসির অনেক ক্ষমতা, বাড়াবাড়ি করলে আমার অনেক ক্ষতি হবে। আমি ঢাকার বাইরে একটি চাকরি করছি। সেখানেও আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন মাহমুদুল হক।
ওই তরুণী বলেন, সবশেষে বাধ্য হয়ে আমি মতিঝিল জোনের এডিসি শিবলী নোমানকে বিষয়টি জানাই। তিনি বিষয়টি মীমাংসা করে দেবেন বলেও জানান। মাহমুদুলের বাবাকেও বিষয়টি জানাই। তবুও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি আইজিপি বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। মাহমুদুল হক আমাকে বিয়ে না করলে আমি আদালতে মামলা করব।
অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোনালিসা বেগম বলেন, ‘ভুক্তভোগী তরুণী আইজিপির কাছে ওসি মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। সেটির তদন্ত করি আমি। অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে। ১৯ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন ডিএমপি সদর দপ্তরে পাঠিয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হক রোববার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, আমি সূক্ষ্ণ ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা ও বানোয়াট।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ওসি মাহমুদুল হক ২০০১ সালে এসআই পদে পুলিশে যোগ দেন। তার বাড়ি নওঁগা জেলায়। চাকরি জীবনে তিনি একটি গুরুদণ্ড-ব্ল্যাক মার্ক এবং ২২টি লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তিনি ২০১৭ সালের ২ জুলাই পল্টন থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। তার স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/সেপ্টেম্বর ৩০,২০১৯)