তাপস কেন সরব?
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: শেখ ফজলে নূর তাপস ধানমণ্ডি থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ। তার চেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি’র ছোটছেলে। ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতির পাদপ্রদীপে এসেছিলেন।
ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন আওয়ামী লীগপন্থী ডাকসাইটের আইনজীবীরা শেখ হাসিনাকে আইনি সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের মতো আওয়ামী পন্থী আইনজীবীরা যখন শেখ হাসিনার মামলার ফাইল ফেরত পাঠিয়েছিলেন, ঠিক সেসময় অপেক্ষাকৃত তরুণ আইনজীবী ব্যারিস্টর ফজলে নূর তাপস আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপরে তিনি রাজনীতিতে আলোচিত হন। ধানমন্ডির আসন থেকে ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে তার যতটা খ্যাতি, কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ততটাই চুপচাপ এবং নীরব ছিলেন এতোদিন। কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই তাকে খুব বেশি সোচ্চার দেখা যায়নি। এলাকার কাজকর্ম নিয়ে তিনি ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাপস সরব হয়েছেন। তার সরব হওয়াটা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল অনেকটা ইঙ্গিতবাহী মনে করছেন।
ফজলে নূর তাপসকে প্রথম সরব দেখা যায় ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের আটকাদেশ নিয়ে। সেসময় আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও সম্রাট কেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন না। তার এই কথায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মজার ব্যাপার হলো তাপসের এই প্রশ্নের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই সম্রটাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তাপস দ্বিতীয় দফায় সরব হন এই সপ্তাহেই। তিনি দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে ব্যর্থতার দায়ে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। উল্লেখ্য যে তিনি বেসিক ব্যাংকের কেলেংকারি নিয়ে আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অভিযোগে দুদক চেয়ারম্যানকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন। তিনি বাচ্চুর বিরুদ্ধেও এখন সোচ্চার হয়েছেন। তাপস বলেছেন, আবদুল হাই বাচ্চুকে কেন এখনো আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। তাপসের এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ চলছে। কেন তিনি এমন সরব হলেন এবং কয়েকজন ব্যক্তিকে টার্গেট করে কেন তিনি বক্তব্য রাখছেন, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানারকম গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। তাপস এমন একটা সময়ে এই কথাগুলো বলছেন, যখন তার পিতার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী যুবলীগ সমালোচনায় বিদ্ধ। ক্যাসিনো বাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যের অভিযোগে সংগঠন লন্ডভন্ড। এবং যুবলীগের দায়িত্ব পালন করছিলেন তারই ফুপা ওমর ফারুক চৌধুরী। এই প্রেক্ষাপটে ফজলে নূর তাপসের বক্তব্য যে স্রেফ কথার কথা, এমনটি নয়। তাপসের যে রাজনৈতিক ইতিহাস, সেটা বিশ্লেষণ করলে এটা বোঝা যায় যে তিনি অন্য রাজনীতিবিদদের মতো মাঠ গরম করা বক্তৃতা দেন না। তার বক্তৃতাগুলো তাৎপর্যপূর্ণ, উদ্দেশ্যমূলক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাপস হঠাৎ সরব হওয়ার পিছনে তিনটি কারণ রয়েছে;
১. তার পিতার যে সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ, সেই সংগঠনটিতে যখন এমন অবস্থা তখন নিশ্চয়ই তিনি কষ্ট পেয়েছেন। কারণ যুবলীগের কোনো প্রত্যক্ষ সদস্য না হলেও, এই সংগঠনটিকে ঘিরে তাপসের আবেগ রয়েছে। কারণ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার পিতা। সেই সংগঠনটির যখন এই অবস্থা তখন নিশ্চয়ই তিনি কষ্ট পেয়েছেন। যুবলীগের কোন সদস্য বা যুবলীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও এই সংগঠনটি ঘিরে তাপসের আবেগ রয়েছে। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার পিতা। সে কারণে তাপস ক্ষুব্ধ এবং দলের ভিতর দুর্বৃত্তায়নের কারণে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে করার জন্য তিনি আহ্বান করেছেন।
২. রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া কিংবা জিকে শামীমদের মত যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার আব্দুল হাই বাচ্চুর মত যারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর টাকা লুট করে নিয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যেহেতু তাপস আওয়ামী লীগের দু:সময়ের কাণ্ডারিদের একজন তিনি মনে করছেন, এই সমস্ত অভিযুক্তদের যদি আইনের আওতায় না আনা হয়, তাদের বিরুদ্ধে যদি আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের এই শুদ্ধি অভিযান ব্যর্থতায় পরিণত হবে। এজন্যই শুদ্ধি অভিযান যেন সফল হয় তাই আব্দুল হাই বাচ্চুর একটি প্রতীকি নাম ব্যবহার করে তিনি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তাদেরকে যেন গ্রেপ্তার করা হয় সেই আহ্বান করেছেন।
৩. অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনের সময় তাপস শেখ হাসিনার পক্ষে আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়েছিলেন। তাদের যে পারিবারিক সখ্যতা তাই অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি হয়তো কিছু কিছু জনমত গঠনের জন্য এবং বিভিন্ন মহলে চাপ সৃষ্টির জন্য ফজলে নূর তাপসকে দিয়ে এ ধরনের কথাগুলো বলাচ্ছেন।
এর আগেও দেখা গেছে, ইসমাইল চৌধুরি সম্রাটের ব্যাপারে যখন তাপস যখন মুখ খুলেছেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাকে গ্রেপ্তার করেছেন। আব্দুল হাই বাচ্চুর ব্যাপারেও তাপসের এই বক্তব্য শেখ হাসিনার প্রশ্রয় এবং সমর্থনে করা কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, ফজলে নূর তাপসের মত স্বচ্ছ এবং ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বর্তমান শুদ্ধি অভিযানে স্বস্তি পেয়ে হতাশা কাটিয়ে উঠে চাঙ্গা হচ্ছেন। তারই ফলশ্রুতিতে সরব হয়েছেন ফজলে নূর তাপস।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/অক্টোবর ১৫,২০১৯)