দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: এবার বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে এপর্যন্ত বজ্রপাত ও পানিতে ডুবে ৫১০ জনের ‘অপমৃত্যু’ হয়েছে, যার বড় অংশই শিশু। একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার পরও এ মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা না গেলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে না। আর শিশু সুরক্ষা নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন, বজ্রপাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারাদেশে নতুন দুর্যোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে, যার আঘাতে বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও মৃত্যু হচ্ছে। এক্ষেত্রে দুর্যোগ ও ঝড়-ঝঞ্ঝার সময় শিশুদের নিরাপদ স্থানে রাখা, চলাচল সীমিত এবং খোলা স্থানে বা মাঠে খেলতে দেওয়া উচিত নয়।

গত ৯ মাসে সারাদেশে বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা ২০৫। এর মধ্যে জুনে সর্বোচ্চ ৪১ জন নিহত হন। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজাস্টার ফোরাম এ তথ্য দিয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান মতে, ২০৫ জনের মধ্যে ৩২টি শিশু, ২৫ জন নারী ও ১৪৮ জন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে। আর বজ্রপাতে আহতের সংখ্যা ১০৩ জন।

এদিকে এ বছর বর্ষা মৌসুমে ৩০৫ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে, এর মধ্যে ২০৬ জন শিশু। মেয়ে শিশু ৮৬, আর ছেলে শিশুর সংখ্যা ১২০টি। ১০ জুলাই থেকে ২২ জুলাই বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৬, এর মধ্যে ৬০ জন শিশু। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, কেবল গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এটা পাঁচ বছরের কম বয়সী মোট শিশুমৃত্যুর প্রায় ৪৩ শতাংশ। কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে গবেষকরা বলছেন, চারদিকে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর জলাশয়−পুকুর, নদী, ডোবা, খাল, বিল রয়েছে। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো পুকুর। পানিতে ডুবে ৬০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে। কারণ, এ সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন এবং পরিবারের সদস্যরা বাইরে থাকেন।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স ও চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। বছরের বিশেষ সময়ে এই মৃত্যুর হার বেশি। বছরের পর বছর এ দুর্ঘটনা চলতে থাকলেও এটা নিয়ে বড় কোনও সুরক্ষামূলক উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অধিকাংশই সচেতনতা ও সুরক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ঠেকানো যেতো।’

নৌ বা লঞ্চ ডুবিতে শিশু মৃত্যুর হারও কিন্তু কম নয়। এক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের সার্বক্ষণিক তদারকিতে রাখতে হবে এবং এ বয়স থেকে শিশুকে সাঁতার শেখাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি বাড়ির পাশের পুকুর, ডোবা বা জলাশয়গুলোতে শিশুর ঝুঁকি কমানোর মতো সহজ ও নিরাপদ অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। শুধু তাই নয়, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার উপমহাদেশে সবচেয়ে কম ভারতের কেরালায়। স্কুলে যেতে শুরু করার আগ পর্যন্ত শিশুদের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখাশোনার জন্য একটা সামাজিক ব্যবস্থাপনা সরকারের পক্ষ থেকেই গড়ে তোলা হয়েছিল সেখানে। গ্রামের মায়েরা একেকজন একেকদিন সবার পাঁচ বছরের নিচের সন্তানের দেখাশোনা করেন। ফলে একেকজন মা’কে মাসে হয়তো একদিন শিশুর দেখাশোনা করতে হয়।

সেই মডেলটি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন ডিজাস্টার ফোরামের সংগঠক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ শিশু মারা যায় বেলা ১১ থেকে ১টার মধ্যে, যখন মা কাজ করেন। সে সময় শিশুকে দেখার দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। মায়ের পক্ষে একইসঙ্গে বাসার কাজ ও শিশুকে সামলে রাখা সম্ভব না।’

সাঁতার শেখানো প্রকল্পের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যারা মারা যাচ্ছে তাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, আর সাঁতার শেখানো হচ্ছে ছয় বছরের পর।’ সামাজিক সুরক্ষা কবচ গড়ে তোলার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেরালার যে মডেল, সেটি আমরা ব্যবহার করতে পারি।’