দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্ত্রী ও তার কিশোরী গৃহকর্মী খুনের ঘটনা তদন্তে ওই অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির নজরুল ইন্সটিটিউটের পাশের ২৮ নম্বর রোডের (নতুন ১৫ নম্বর) ২১ নম্বর বাড়ি থেকে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়।

এর আগে শুক্রবার বিকালে ধানমণ্ডির ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাট থেকে গৃহকর্ত্রী আফরোজা বেগম (৬৫) এবং তার গৃহকর্মী দিতির (১৭) লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায়, দুর্বৃত্তরা চাকু দিয়ে গলা কেটে আফরোজা ও দিতিকে হত্যা করেছে। ফ্ল্যাটের আলমারি খোলা ছিল এবং জিনিসপত্র এলোমেলো পাওয়া যায়।

পুলিশের ধানমণ্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) হাসিনুজ্জামান জানান, এ জোড়া খুনের ঘটনায় তারিমের পিএস বাচ্চু, বাসার কেয়ারটেকার বেলায়েত, ম্যানেজার প্রিন্স এবং স্থানীয় এক পান দোকানদারসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

ধানমণ্ডি থানার ডিউটি অফিসার এসআই নূর উদ্দিন জানান, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে ডিএমপি রমনা বিভাগের সিনিয়র অফিসারর ঘটনাস্থলে যান।

এরপর সেখানে র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি এবং পিবিআইয়ের সদস্যরা যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা পৃথকভাবে তদন্ত করেন।

পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবদুল্লাহ হিল কাফি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এডিসি কাফি আরও জানান, শুক্রবার ওই বাসায় একজন নতুন কাজের বুয়া এসেছিল।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনো যোগসাজশ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, অ্যাপার্টমেন্টের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে।

অ্যাপার্টমেন্টের চতুর্থ তলা থেকে লিফট দিয়ে নামার পথে স্থানে স্থানে রক্তের দাগ দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘাতক পালিয়ে যাওয়ার সময় তার শরীরের লেগে থাকা রক্ত থেকে ওই দাগের সৃষ্টি হয়েছে।

ঘটনার পর থেকে ওই গৃহকর্মী পলাতক। সে পাঁচ তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে চতুর্থ তলায় নেমেছে। পরে চারতলা থেকে লিফট দিয়ে নিচে নেমেছে।

আফরোজার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। গত নির্বাচনে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগ থেকে তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তার মেয়ে-জামাতা মনির উদ্দিন তারিম বিশিষ্ট শিল্পপতি।

একাধিক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক তারিম একই ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় থাকেন। আর পঞ্চম তলায় থাকতেন তার শাশুড়ি আফরোজা বেগম।

ব্যবসায়ী মনির উদ্দিন তারিম বলেন, তার সন্তান অসুস্থ। তাই তার জন্য স্যুপ কিনতে গিয়েছিলাম। পথিমধ্যে স্ত্রী দিলরুবা সুলতানা রুবার ফোন পেয়ে দ্রুত বাসায় এসে দুইজনের লাশ দেখতে পাই।

শাশুড়ির লাশ সামনের রুমে ছিল। আর দিতির লাশ ছিল পেছনের রুমে। তিনি আরও জানান, সন্তান অসুস্থ হওয়ার পর শনিবার থেকে শাশুড়ি তাদের ফ্ল্যাটেই বেশি সময় কাটাতেন।

শুক্রবার আসর নামাজের আগে তিনি নিজের ফ্ল্যাটে যান। আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়ে ফের মেয়ের ফ্ল্যাটে আসার কথা ছিল। মাগরিবের নামাজের পরও না আসার রুবা তাকে ফোন করেন।

ফোন না ধরায় গৃহকর্মী রিয়াজকে তার ফ্ল্যাটে পাঠানো হয়। বেশ কয়েকবার কলিং বেল টিপেও কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে রিয়াজ দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখেন সেটি খোলা।

ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে আফরোজা বেগমের লাশ পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত উপরে গিয়ে রুবাকে বিষয়টি জানায়। তারিম আরও জানান, বাসা থেকে তিনটি মোবাইল ফোন সেট, আফরোজা বেগমের শরীরের সঙ্গে থাকা সোনার গয়না, আলমারিতে রাখা গয়না, নগদ টাকা এবং এফডিআরসহ মূল্যবান জিনিসপত্র খোয়া গেছে।

বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান জানান, ২০১২ সালে আফরোজা বেগমের স্বামী আশরাফ উদ্দিন মারা যান। আশরাফ ঠিকাদার ছিলেন। ভবনের পঞ্চম ও ৬ষ্ঠতলায় তার দুটি ফ্ল্যাট আছে।

পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন আফরোজা, গৃহপরিচারিকা দিতি ও তারিমের পিএস বাচ্চু থাকেন। আফরোজা বেগমের কোনো ছেলে সন্তান নেই।

তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রুবা স্বামীসহ পঞ্চম তলায় থাকেন। তার এক মেয়ে কানাডা ও এক মেয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ছোট মেয়ে রুবা আইনজীবী।

নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান আরও বলেন, শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে এক পান দোকানদারের সহায়তায় বাচ্চু এক নারীকে নিয়ে আফরোজার বাসায় যান।

ওই নারী বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার কথা বলে বাচ্চুর সঙ্গে উপরে যায়। এরপর ৬টার দিকে বাচ্চু একবার লুঙ্গি পরা অবস্থায় নিচে নামে।

এর কিছুক্ষণ পর ওই নারীও চলে যায়। এরপর বাচ্চু প্যান্ট-শার্ট পরে চলে যান। এরপর ওপর থেকে একটা ছেলে ফোন দিয়ে জানায়, খালাম্মা (আফরোজা) মারা গেছেন।

ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি বেডরুমের মেঝে রক্তে ভেসে গেছে।

নিরাপত্তাকর্মী নুরুজ্জামান আরও বলেন, নতুন গৃহকর্মী বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাকে যেতে দেব কিনা জানতে ইন্টারকমে আফরোজা বেগমের বাসায় আমি ফোন দিই।

কিন্তু ওই বাসার ইন্টারকম নষ্ট ছিল। পরে তার মেয়ের (রুবা) ইন্টারকমে ফোন দিলে কেউ রিসিভ করেনি। ‘বেতন কম তাই কাজ করবে না’ জানিয়ে গৃহকর্মী চলে যায়। তার হাতে কোনো ব্যাগ ছিল না। আসার সময়ও কোনো ব্যাগ ছিল না।

রুবার ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী রিয়াজ জানায়, ‘আফরোজা বেগমকে রুবা ম্যাডাম বারবার ফোন দিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি ফোন ধরছিলেন না। তাই তিনি আমাকে ৬ষ্ঠ থেকে পঞ্চম তলায় গিয়ে দেখে আসতে বলেন।

আমি গিয়ে দেখি, আফরোজা বেগম ফ্লোরে পড়ে আছেন, রক্তমাখা। আমি দৌড়ে উপরে গিয়ে বিষয়টি জানাই।’ এরপর অপর গৃহকর্মী আপেলসহ রুবা ম্যাডাম পঞ্চম তলায় যান। তখন তারা নতুন গৃহকর্মীকে খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/নভেম্বর ০২,২০১৯)