ফিরেও তাকালেন না গোপীবাগের খোকা
মাহমুদ হাসান: পুরো ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়ালেন। সাথে লাখো ভক্ত, অনুরাগী আর সমর্থক নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন রাজধানীর নানা গলি ও পথ। সকালে সেই বিমানবন্দর থেকে সংসদ ভবন। শহীদ মিনার থেকে নয়াপল্টন। গুলিস্থানের নগর ভবন হয়ে 'গোপীবাগের খোকা' ধূপখোলা মাঠ হয়ে থামলেন জুরাইনে।
হ্যাঁ, যে গোপীবাগের ধুলো মাটি গায়ে লাগিয়ে বড় হয়েছেন। কৈশোর ও যৌবন পার করেছেন, হাজারো স্মৃতি বিজড়িত গোপীবাগেও গিয়েছিলেন তিনি। গিয়েছিলেন সব চাইতে প্রিয় জায়গা নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করা ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। জীবনের অনেকটা সময় দিয়েছেন তিনি এখানে। ১৯৯১ সালে প্রথম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও নিত্যদিন আড্ডা দিতেন ক্লাবে। আজও গেলেন। কারোরই কোন ব্যস্ততা নেই। ক্লাবের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি আসলেন অথচ কেউ বসতে বলল না। ব্যস্ত নগরবাসীর পুরো দিনটিই কেড়ে নিয়েছিলেন আজ তিনি। '৭১ সালে ঢাকা শহরে যার ভয়ে তটস্থ থাকতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের একজন চতুর গেরিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর সময়ের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে যার পদভারে প্রকম্পিত হতো রাজধানী, তিনি আজও রাজপথে ঘুরলেন। সামনে পিছনে হুইসেল বাজিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে একা শুয়ে তিনি দেখছিলেন তাঁর প্রিয় ঢাকা শহর। মনে হচ্ছিল যেন তিনি আজ একই সূত্রে গেঁথে নিয়েছেন সবাইকে। পুরো শহরটাকেই পরিনত করেছিলেন মিছিলের শহরে। অথচ কেউই আতংকিত হলো না। তিনি আজ লাখো জনতার সাথেই অবস্থান করলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না। ছিল না তাঁর কোন নির্দেশনা। দিলেন না কোন হুংকার। উঠেনি কোন শ্লোগানের ধ্বনি। নিরব-নিথর হয়ে শুয়ে থাকলেন। সহকর্মী, ভক্ত, অনুসারী ও রাজনৈতিক কর্মীরা চোখের জলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। পরম করুণাময়ের কাছে দোয়া করলেন। কিন্তু তিনি কাউকেই প্রতিউত্তর দিলেন না। কারো দিকে ফিরেও তাকালেন না। ফুলে ফুলে ভরে উঠল তার চারপাশ। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাঝে মাঝে সরিয়ে ফেলা হলো কিছু ফুল। তবু কোন অনুযোগ নেই উনার। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ব্যক্তিরা এমনকি যাঁদের সাথে দলীয় ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা ছিল সার্বক্ষণিক তাঁরাও আজ বাকরুদ্ধ। কারো ডাকেই সাড়া দেয়া হলো না আজ। বিপক্ষকে জয়ী করে চির বিদায় নিলেন প্রিয় সাদেক হোসেন খোকা।
আপনাকে শেষ দেখা দেখতে অনেকেই এসেছেন কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে, কেউবা এসেছেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রেখে। আবার লাঠিতে ভর করে বা কারো সাহায্য নিয়েও অসংখ্য বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ এসেছেন। ভগ্ন স্বাস্থ্য আর কম্পমান শরীর নিয়ে তারা চেষ্টা করেও আপনার কাছে যেতে পারেননি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু সজল নেত্রে দেখেছেন আপনার শবযাত্রা। কিন্তু এত বয়ষ্ক মানুষ দেখেও আজ আপনি হাত তুললেন না। বড় ফ্রেমের চশমা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন না। অত বড় চশমার ফ্রেম খুব একটা মানানসই লাগে না। কিন্তু আপনাকে যেন ওটাতেই মানিয়েছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওই চশমা ছাড়া আপনাকে দেখি। কিন্তু সম্ভব হলো না। দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম ওই চশমা ছাড়া আপনাকে দেখব কিনা? শেষ পর্যন্ত না দেখার সিদ্ধান্তেই অটল থাকলাম। ঘুরে ফিরে দেখলাম ভিন্ন ধর্মের অসংখ্য মানুষ আপনার জন্য প্রার্থনা করছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। আগে থেকে কিছুটা জানা থাকলেও আজ অনেকের কাছেই শুনলাম আপনার স্পর্শে রাজধানীর অসংখ্য মানুষ তাদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। হয়েছেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এটা একান্তই আপনার বিষয়। কিন্তু আমি সে দলে না। পেশাগত কারণ ছাড়া খুব একটা দেখা সাক্ষৎ হতো না আপনার সাথে। তখন আপনি মেয়র। আপনার দলের মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও আপনি। কথা হতো রাজনীতি নিয়ে। খুঁজতাম কোন স্কুপ নিউজ। ১/১১ এরপর সরকারে আওয়ামী লীগ। একদিনের ঘটনা। বেশ রাত। রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের বাসা থেকে বের হবেন। গাড়িতে বসা। আমি ঢুকছি। গাড়ির ভিতর থেকে ডাকলেন। মাহমুদ কেমন আছ? নেমে আসলেন কালো রংয়ের পতাকাবাহী পাজেরো জীপ থেকে। কুশলাদির পর জানতে চাইলেন আরো অনেক কিছুই। আমার জন্য গাড়ি থেকে নেমে কথা বলতে হবে? এই দুর্লভ আচরণ আমি খুব কমই দেখেছি। আগে-পরে আরো অনেকবার কথা হয়েছে আপনার সাথে। কিন্তু ওই দিনের ঘটনা আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে। ১১১ এর সময় আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাসে কিছুটা ফাটল ধরেছিল বলে অনেকেই বলেন। ওই সময়ের আপনার কিছু কার্যক্রম নিয়ে এখনো অনেকে অনেক কথা বলেন। এগুলো আমার বিষয় নয়। আপনার রাজনীতি ভুল না শুদ্ধ। তা যাচাই-বাছাই বা চুল চেরা বিশ্লেষণ করবে গবেষকেরা। মূল্যায়ন করবে আপনার দলের নেতা-কর্মীরা। তবে দেখেছি আপনি খুব সহসাই নিজের অবস্থান সুসংহত করে নিয়েছিলেন। দ্রুতই ফিরে পেয়েছেন সম্মান আর অবস্থান। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে এখন। ১৯৯৫ সাল। আপনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ও সেই সময়ের ('৯৫ সাল) শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী লেঃ জেনারেল মীর শওকত আলী বীর উত্তম। মীর শওকত তাঁর নির্বাচনী এলাকার কয়েকটি ক্লাব ও তরুণ-যুবকদের কয়েক সেট খেলার সামগ্রী দেয়ার জন্য ক্রীড়া মন্ত্রীকে ডিও লেটার দেন, আমিই সেই চিঠিটি হাতে হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম আপনার কাছে। আপনি খুব আয়েশি ভঙ্গিতে মন্ত্রীর চেয়ারে বসা। আমার উদ্দেশ্যের কথা জানতে চাইলেন। এর মাঝেই আপনার লাল ফোনটি বেজেঁ ওঠল? আপনি ফোন রিসিভ করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। 'জ্বী স্যার জ্বী স্যার' কয়েকবার বললেন। শেষে বললেন 'মাহমুদ আমার সামনেই বসা স্যার।' কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলেন। আপনার রুমে বসা অসংখ্য মানুষ এই কথাগুলো শুনছিলেন। এভাবে স্যার ডাকা বা কাকে সম্বোধন করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললেন একজন। আসলে রাজনৈতিক কর্মীদের জানার আগ্রহ বেশীই থাকে। আপনি খুব ঠান্ডা মাথায় বললেন, জেনারেল স্যার। মানে মীর শওকত আলী। উনি সেক্টর কমান্ডার না? সব মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। এই গল্পটা এখনো সুযোগ পেলেই আমি বলি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আপনার যে কি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা তা এই ঘটনা দিয়ে প্রমান পেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এই গেরিলা যোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন অসীমে সাহসিকতায়। আর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে সেক্টর কমান্ডার ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়। শুধু মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নয় ভাষা সৈনিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নামেও নামকরণ করেছেন বিভিন্ন রাস্তার।
আপনার প্রিয় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আপনাকে শুইয়ে রেখে আরো অনেক টুকরো স্মৃতি মনের কোনে ভেসে আসছিল। কিন্তু কি বলব আপনাকে? আজ তো আপনি কারো সাথে কথাই বললেন না। আমারও আর ভাবতে ভাল লাগছে না। নয়াপল্টন থেকে আপনাকে এখন নিয়ে যাবার প্রস্তুতির কথা শুনেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল আমার আশেপাশে থাকা কিছু মানুষ। কোন ভ্রুক্ষেপই করলেন না আপনি। বাম ছাত্র রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের দামামা। অতঃপর মধ্যপন্থী রাজনীতিতে প্রবেশ। হয়েছেন নেতা, সংগঠক, ক্রীড়া সংগঠক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী-মেয়র। কিন্তু আজ যে কোন কিছুর হাতছানিই আপনাকে রাখা গেল না। বিচ্ছিন্ন ও এলোমেলো কিছু ভাবনা ভর করল। এভাবে বেশ কিছু সময় চলে গেল ...নানা প্রসঙ্গ নিয়েই জটলা করে কথা বলছিলাম একজন গীতিকার আর একজন সাংবাদিক ও এক রাজনৈতিক কর্মীর সাথে। বেশ আগেই আপনার নিথর দেহখানি নিয়ে চলে গেছে লাশবাহী গাড়ীটি। মনে হলো অনেকের বুক ফাঁকা করে চলে গেলেন আপনি। হন্তদন্ত হয়ে উন্মাদ প্রায় এক ষাটোউধ্ব নারী জানতে চাইলেন খোকা ভাইকে কি নিয়ে গেছে? বললাম, হ্যাঁ। জানতে চাইলেন, এখন কোথায়? বললাম, নগর ভবনে পেতে পারেন। তারপর কোথায় নিবে? বললাম গোপীবাগ ও তারপর ধূপখোলা মাঠ। বললাম, এসব জায়গায় যদি না পান তাহলে সোজা চলে যাবেন জুরাইন কবরস্থানে। এখানেই যে নতুন ঠিকানা গেড়েছেন 'গোপীবাগের খোকা ভাই'। বড় অসময়ে অনেককেই রাজনৈতিক অভিভাবকহীন করে প্রস্থান আপনার।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক অপারেশন পরিচালনা করেন সাদেক হোসেন খোকা। আর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা। তার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
(দ্য রিপোর্ট / টিআইএম/০৯ নভেম্বর,২০১৯)