কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি সেই আবজালের
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণির সেই আলোচিত কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের দুর্নীতির অর্থ শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অন্তত এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তাদের নামে-বেনামে।
কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা। লন্ডন ও মালয়েশিয়ায় চারটি ব্যাংকে তাদের বিপুল অর্থ রয়েছে। লন্ডনে রুবিনা খানমের নামেই চারটি হিসাবে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আর মালয়েশিয়ায় দু’জনের (আবজাল ও রুবিনা) ব্যাংক হিসাবেও কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়া আবজাল ও তার স্ত্রীকে এবং তাদের পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। এরই অংশ হিসেবে দুদক থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই চার দেশে এমএলএআর (মিচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স) পাঠানো হয়েছে।
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থাকায় বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে এমএলএআর পাঠানো হয়।
এদিকে, আবজালের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুদকের টিম। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আবজাল দম্পতির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়। ১০ জানুয়ারি আবজালকে দুদকে ডেকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার কাছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেননি।
তিনি একপর্যায়ে দুদক কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। তাতে কাজ না হলে তিনি একজন কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরে বলেন তিনি একা দুর্নীতি করেননি। এর পেছনে আরও অনেকেই রয়েছে।
ওইদিন দুদক কর্মকর্তারা আবজালের কাছে পাসপোর্ট, এনআইডি কার্ড ও দুর্নীতিসংক্রান্ত কিছু ডকুমেন্টস চান। তিনি সেগুলো দেবেন বলে সময় নিয়ে দুদক থেকে বেরিয়ে আসেন। এরই মধ্যে দুদকের আবেদনে ২২ জানুয়ারি আবজাল দম্পতির সব সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাবে লেনদেন অবরুদ্ধের (ফ্রিজ) জব্দের আদেশ দেন আদালত।
কিন্তু ওই আদেশ জারির আগে ও পরে তিনি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের ২১টি শাখা থেকে অন্তত ১০০ কোটি টাকা তুলে ফেলেন বলে সূত্র জানায়। দুদকের তদন্তে ব্যাংকে লেনদেন স্থগিতের পরও টাকা প্রদানে সহায়তাকারী কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে এসেছে বলে জানা যায়। তাদের বিরুদ্ধে আলাদা অনুসন্ধান করার কথা ভাবছে দুদক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক বরাবর দুদক থেকে পাঠানো চিঠিতে আবজাল, তার স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া ছাড়াও তারা দেশের বাইরে কি পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন সেই তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পরপর ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর আবজাল কয়েক কোটি টাকার ডলার করেন। বাকি টাকার মধ্যে কিছু টাকা খরচ করেন নিজেকে রক্ষায়। দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগও খুঁজতে থাকেন। কয়েক কোটি টাকা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেন বলে পরে অভিযোগ পায় দুদক। এ অবস্থায় তিনি গোপনে একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সে স্ত্রীসহ দেশ ত্যাগ করেন।
এদিকে, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও আবজাল-রুবিনা কিভাবে দেশ ত্যাগ করলেন- সে বিষয়ে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট অনুসন্ধান করে। তখন জানা যায়, আবজাল দম্পতি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন।
আবজাল দম্পতিসহ স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তদন্ত তদারক করছেন দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম। তার এ টিমে দু’জন উপপরিচালক, তিনজন সহকারী পরিচালক ও তিনজন উপসহকারী পরিচালক রয়েছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, টিমের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যত যাত্রী ঢাকা ত্যাগ করেছেন তাদের নামের তালিকা ও পাসপোর্ট নম্বর চাওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই তথ্য দুদকের হাতে এসে পৌঁছেনি। আগামী সপ্তাহে তালিকাটি পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানায়, দুদকের তদন্তে পাওয়া আবজাল দম্পতির নামে-বেনামে থাকা সব স্থাবর-অস্থার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। এর আগে তাদের ৩১৯ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছিল। ২৭ জুন করা দুদকের মামলায়ও ওই সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। দুদকের তদন্তে ৫ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান মিলেছে বলে সূত্রটি জানায়। উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের তদন্ত করছেন।
আবজালের দুর্নীতির তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, আমাদের টিম কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা হবে। তিনি বলেন, আবজাল দম্পতি দুদকের মামলার আসামি হিসেবে এখন পলাতক। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। তারা দেশের বাইরে আছেন এমন তথ্যও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের ফিরিয়ে আনাসহ পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কে এ আবজাল : দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আবজাল হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরে। ১৯৯২ সালে তৃতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তার। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের সুপারিশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৫টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে অফিস সহকারী পদে অস্থায়ীভাবে যোগ দেন তিনি।
২০০০ সালে প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ক্যাশিয়ার পদে বদলি হন। পরে তিনি মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ঢাকায় বদলি হন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য খাতের বড় একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মেলান।
আবজাল হোসেনের স্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদফতরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ১৯৯৮ সালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। কিন্তু দুর্নীতির কারণে তার চাকরি চলে যায়। পরে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ব্যবসা করেন করেন আবজাল। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পেতে তিনি রুবিনা খানমের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স করেন।
গত ১০ বছরে আবজাল স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং টেন্ডার আহ্বানসংক্রান্ত কমিটির সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে এককভাবে শত শত কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেন। অন্য কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যাতে কাজ না পায় সেজন্য আবজাল নিজের স্ত্রী ছাড়াও তার ভাই ও শ্যালকের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে তাদের সর্বোচ্চ দরদাতা দেখিয়ে তিনি একচ্ছত্রভাবে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নেন।
এভাবে তিনি কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এমনকি অনেক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই তিনি বিল তুলে নেন। আবজালের মাসিক বেতন ছিল সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ তিনি ‘হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের’ গাড়ি ছাড়া চলতে পারতেন না।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/নভেম্বর ১৬,২০১৯)