গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হলো আজ। রায়ে মামলার ৭ জীবিত আসামির প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর লিটনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার ঘটনায় বিস্মিত হয়েছিল গোটা দেশ। আর এই হত্যার নেপথ্য কাহিনীটা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রায় আড়াই মাস ধোঁয়াশায় ছিল পুলিশ। পরে একে একে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা যায়, ঠাণ্ডা মাথায় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তারই এলাকার জাপা দলীয় সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. আবদুল কাদের খাঁন। এ লক্ষ্যে কাদের তার সুন্দরগঞ্জের ছাপরহাটি ইউনিয়নের খানপাড়া গ্রামে নিজ বাসায় তিনজনকে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা কাদেরের কথা অমান্য করে হত্যা মিশনে অংশ নেয়নি। প্রথমবারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর ২০১৬ সালের শুরুতে আবার নতুন ছক কষেন কাদের। এরপর তিনি স্থানীয় জাপা নেতা সোহেল রানা, শাহীন মিয়া ও মেহেদীকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দিয়ে লিটনকে হত্যা করতে রাজি করান। তাদেরও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কাদেরের বাসায়।

ঘটনার দিন ‘গুরু’ কাদেরের কাছ থেকে ‘দোয়া’ নিয়ে তারই কিনে দেওয়া রানার ব্র্যান্ডের একটি মোটরসাইকেলে লিটনের বাসায় গিয়ে ‘মিশন’ সফল করে তিন খুনি। এরপর তারা আবারও ফিরে যায় কাদেরের বাসায়। সেখানে খুনিদের মিষ্টিমুখ করান কাদের, দেন নগদ ১৫ হাজার টাকা। আবার খুনিদের নিয়ে কাদের তার গাড়িতেই গাইবান্ধা থেকে বগুড়া ফিরে যান। এমপি লিটন হত্যায় জড়িত সন্দেহে শাহীন ও মেহেদীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা যায়, শুধু এমপি লিটন নন, কাদের গাইবান্ধায় ছয়জনকে হত্যার জন্য নামের তালিকা করেন। এমপি লিটন ছিলেন তার এক নম্বর টার্গেট। দুই নম্বর ছিলেন স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার শামীম পাটোয়ারী। টার্গেট লিস্টের বাকি চারজনও স্থানীয় জাপা নেতা। ’সিরিয়াল’ এই কিলিং মিশন সফল করতে একটি আলাদা মোবাইল ফোন সেট ও সিম নম্বর নেন কাদের। ওই নম্বর থেকে তিনি ভাড়াটে খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

এমপি লিটনের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে কাদের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও স্থানীয় সাংবাদিক চন্দন কুমার সরকারকে ভাড়া করেন। হত্যার আগে এমপি লিটনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কাদেরকে অবগত করেন চন্দন।

রাজনীতির পথ মসৃণ করতেই এমপি লিটনসহ ছয়জনকে হত্যার ছক কষেছিলেন কাদের। ২০০৮ সালে মহাজোট থেকে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন কাদের খাঁন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন লিটন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি যেন এমপি হতে পারেন এজন্যই লিটনসহ ছয়জনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন কাদের।

কাদের খাঁনের ভাড়াটে প্রশিক্ষিত খুনিরা একাধিক দফায় এমপি লিটনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেও ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বরও তিন ভাড়াটে খুনি শাহীন, মেহেদী ও রানা মোটরসাইকেলে লিটনের সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর শাহবাজ গ্রামে যায়। তবে ওই দিন চন্দন ফোনে কাদেরকে জানান, ’ওই পরিস্থিতিতে অপারেশন চালানো ঠিক হবে না। লিটনের বাসায় পুলিশ রয়েছে।’ এরপর কাদের তিন খুনিকে ফেরত আসতে নির্দেশ দেন। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর চন্দন আবার ফোনে কাদেরকে জানান, ’হামলা করার জন্য ওই দিন উপযুক্ত সময়।’ এমন গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে আগে থেকে কেনা মোটরসাইকেল নিয়ে তিন খুনি শাহবাজ গ্রামে যায়। গাইবান্ধায় খানপাড়ার কাদেরের বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মোটরসাইকেলটির ’ব্র্যান্ড পরিচিতি’ লাল স্কচটেপ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাওয়ার আগে কাদের তিন ভাড়াটে খুনিকে বলেন, ’এবার যেন মিশন সম্পন্ন করে বাসায় ঠিকভাবে ফেরা হয়।’

লিটনকে খুন করতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল মেহেদী, মাঝে ছিল রানা ও পেছনে বসা ছিল শাহীন। যুবলীগ কর্মী পরিচয়ে এমপি লিটনের বাসায় ঢোকার পর তারা একটি ক্লাব তৈরি করতে এমপির সাহায্য চায়। এমন কথোপকথনের মধ্যেই লিটনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে শাহীন ও মেহেদী। পরে গুলি চালায় রানাও। লিটন হাত দিয়ে গুলি ঠেকানোর চেষ্টা করেন। হত্যা মিশনে তিনটি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। একটি কাদেরের লাইসেন্স করা অস্ত্র; অন্য দুটি পুরনো অস্ত্র। হত্যা মিশন সম্পন্ন করে মোটরসাইকেলে গাইবান্ধায় কাদের খানের বাসায় ফিরে যায় তিন খুনি। বাসায় যাওয়ার পরপরই তারা মিশন সফল হওয়ার খবর দেয়। তিনটি অস্ত্র কাদের খানের কাছে ফেরত দেয় তারা। সেখান থেকে বগুড়া হয়ে আগমনী পরিবহনের একটি বাসে ঢাকায় আসে এবং পরে কাদেরের নির্দেশে তিন খুনি নারায়ণগঞ্জে চলে যায়।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/নভেম্বর ২৮,২০১৯)