পঞ্চগড় প্রতিনিধি: ভোরের আলো ফুটতেই তা গিয়ে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায়। চারপাশে তখনও আবছা অন্ধকার থাকলেও চকচক করে পর্বত চূড়াটি। সূর্যের আলোর সঙ্গে কখনো শুভ্র, কখনো গোলাপি, কখনো বা লাল রং নিয়ে হাজির হয় বরফে আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারত বা নেপালে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুযোগ নেই অনেকেরই। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোহর দৃশ্য দেখার সুযোগ মিলছে বাংলাদেশ থেকেই।

দেশের একমাত্র ‘হিমালয়কন্যা’ পঞ্চগড়ে সবুজ মাঠের পাশে ভেসে উঠছে ছবির মতো সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই সঙ্গে দেখা মিলছে ছায়ার মতো দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলেরও। পঞ্চগড়ে হালকা এই শীতের সময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দর্শনের সবচেয়ে ভালো সময়। এখন অনেক পর্যটক পঞ্চগড়ে ছুটে আসছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্ব শ্রেণি হিমালয়ের দ্বিতীয় উচ্চতম ও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করতে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসনও নিয়েছে নানা ব্যবস্থা। পঞ্চগড়ের প্রায় সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও সবচেয়ে ভালো করে উপভোগ করা যায় তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীর তীরে জেলা পরিষদের ঐতিহাসিক ডাকবাংলো থেকে। নদীর ওপারেই ভারত। ভারতের সিকিম রাজ্য ও নেপালে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পঞ্চগড়ে প্রতিবছর হেমন্ত ও শীতকালের শুরুতে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভালো দেখা গেলেও তাতে প্রকৃতি কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্ত হলো—মেঘ ও কুয়াশামুক্ত গাঢ় নীল আকাশ। এমন আবহাওয়াতেই পঞ্চগড়ে চমৎকারভাবে ভেসে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

স্থানীয় লোকজন জানান, হালকা শীতে পরিষ্কার আকাশে উত্তরে চোখ মেললেই দেখতে পাবেন খোলা মাঠের ফাঁক দিয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্ময়কর সৌন্দর্য উপভোগ করতে শীত এলেই পঞ্চগড়ে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। এ বছরের মধ্যে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার (৫ ও ৬ ডিসেম্বর) সবচেয়ে ভালো করে দেখা গেছে হিমালয়ের এই চূড়া।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, তেঁতুলিয়া উপজেলার ঐতিহাসিক ডাকবাংলোতে অনেক পর্যটকের ভিড়। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পঞ্চগড়ে ঘুরতে এসেছেন। মহানন্দা নদীর এপার থেকেই তারা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করছেন। কেউবা পর্বত চূড়ার সঙ্গে নিজেকে ছবিবন্দি করছেন।

কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর এবং বিকেল বেলা। এ সময়ের আলোয় পর্বত চূড়াটি পোড়ামাটির রং নেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসে। তখন রং হয় সাদা। দূর থেকে মনে হয় এটি আকাশের গায়ে এক খণ্ড বরফ। পর্বত চূড়াটির নিচ দিয়েই কালো রঙে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি এলাকা দেখা যায়। সন্ধ্যায় দার্জিলিংয়ের জ্বলে ওঠা বাতিগুলোও এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়।

এছাড়া পঞ্চগড়ের নানা পর্যটনকেন্দ্র প্রকৃতিপ্রেমীদের বাড়তি খোরাক জোগায়। পুণ্ড্র, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জনপদ। এখানে রয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্ত বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, জিরো পয়েন্টের জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি, সমতল ভূমির চা বাগান, মুঘল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বোদেশ্বরী পীঠ মন্দির, দেড় হাজার বছরের পুরনো মহারাজা দিঘি, ভিতরগড় দুর্গনগরী ও দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর পঞ্চগড়ের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে কদর বাড়ছে পঞ্চগড়ের।

ঢাকার উত্তরা থেকে ঘুরতে আসা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘সত্যিই চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেসে আছে ভাবতেই পরছি না! সীমান্ত নদী মহানন্দার তীরে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা উপভোগ করার মজাই আলাদা।’

বগুড়ার আব্দুল রশিদ বলেন, ‘শীতের এই সময়টিতে পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়—এ খবর শুনে পরিবার নিয়ে এসেছি। খুব ভালো লাগল পর্বত চূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে। সেই সঙ্গে সমতলের চা বাগান, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, মহারাজার দিঘিসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছি। সব মিলে পঞ্চগড়ের প্রকৃতি আমাদের মুগ্ধ করেছে।’

পাবনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এমন বিস্ময়কর সৌন্দর্য আমি আগে কখনো দেখিনি। আমরা ভাগ্যবান যে এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছি।’

তেঁতুলিয়ার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘পরিষ্কার, মেঘমুক্ত আকাশেই কেবল কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। এবার অক্টোবর থেকে অনেকবার চমৎকারভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেছে।’

ঠাকুরগাঁওয়ের মুশরাত জাহান নিলা বলেন, ‘অনেকেই পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আসে। কিন্তু আমরা দেশের ভেতর থেকেই এই পর্বত চূড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পেলাম।’

জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘শীতের এই সময় দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। সেই সঙ্গে পঞ্চগড়ের অনেক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে তাঁদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন, আমরা সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে পুরনো দুটি ভবনের পাশাপাশি বেরং কমপ্লেক্স নামে নতুন একটি বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। আশা করি পর্যটকরা পঞ্চগড়ে ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।’

কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া দেখতে সামর্থ্যবানরা ছোটেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিলে। টাইগার হিলই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। কেউ কেউ যান সান্দাকপু বা ফালুট। কেউবা নেপালে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু ঘরোয়া পরিবেশে নিজের মতো করে দেখার সুযোগ মেলে কেবল পঞ্চগড়ে।

(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ডিসেম্বর ০৭,২০১৯)