গণপূর্তের ৮ প্রকৌশলীর সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: যুবলীগের কথিত নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) সিন্ডিকেটের সদস্য গণপূর্ত অধিদফতরের দুই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম ও মোসলেহ উদ্দীনসহ আট প্রকৌশলীর সম্পদ অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদের মধ্যে অধিদফতরের দুই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। অন্যদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্য অভিযুক্তরা হলেন— প্রকৌশলী আশরাফুল আলম, মো. সামছুদ্দোহা, মো. নজিবুর রহমান, মো. আবুল খায়ের, মো. শামীম আখতার ও মো. শফিকুল আলম। দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তবে অভিযোগের বিষয়ে আট প্রকৌশলীর কেউই কথা বলতে রাজি হননি। দুদকের সূত্র জানায়, জি কে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে ড. মঈনুল ও মোসলেহ উদ্দীনসহ আট প্রকৌশলীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া, গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির পক্ষে গত ২০ নভেম্বর সোহেল রানা ও গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষে গত ৫ ডিসেম্বর মো. বদরুদ্দীন ওমর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ও মোসলেহ উদ্দীনসহ আট প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ এনে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে পৃথক অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে আট প্রকৌশলীর ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থ-সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, এরইমধ্যে ড. মঈনুল ও মোসলেহ উদ্দীনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। যথেষ্ট নথিপত্রও পাওয়া গেছে। অন্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সরকারের বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে শিগগিরই সহযোগিতা চাওয়া হবে বলেন জানায় দুদক।
প্রসঙ্গত, যুবলীগের কথিত নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে সহযোগিতা, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থ পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে গণপূর্তেরঅতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে সহ ১১ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক। ১৮, ১৯ ও ২৩ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দুদকের পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের অনুসন্ধান টিম জিজ্ঞাসাবাদ করবে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের সম্পদ বিবরণীও নেওয়া হবে।
অন্য যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তারা হলেন— তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিন ও আবদুল মোমেন চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন চাকমা, মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ, মো. ফজলুল হক, আবদুল কাদের চৌধুরী, আফসার উদ্দিন, মো. ইলিয়াস আহমেদ ও ফজলুল হক এবং গণপূর্ত সার্কেল-৪ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার।
গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন এলাকা থেকে গ্রেফতার হন জি কে শামীম। ৩০ সেপ্টেম্বর জি কে শামীম ও তার সহযোগীদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ওই দিন থেকেই সংস্থার পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের অনুসন্ধান দল কাজ শুরু করে। ২১ অক্টোবর দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ঠিকাদার জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম যাদের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে গণপূর্তের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর নাম আছে।
প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
১. চাকরি জীবনের শুরু থেকেই মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আছে। ১৫তম ব্যাচের সহকারী প্রকৌশলীরা ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর যোগদান করলেও মঈনুল ৯ মাস পর ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট চাকরিতে যোগ দেন।
২. ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকরিতে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। ৯ বছর ৮ মাস ২২ দিন অনুপস্থিত থাকায় মঈনুলকে চাকরি থেকে চূড়ান্ত অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য মন্ত্রণালয়ে আপিলের মাধ্যমে তিনি চাকরি ফিরে পান।
৩. গত বছরের ৫ জুন র্যা ব সদর দফতরের নির্মাণ কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এই নির্মাণ কাজের টেন্ডার নিষ্পত্তির চেয়ারম্যান ছিলেন মঈনুল। কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সকে র্যাাব সদর দফতর নির্মাণের কাজ পাইয়ে দেওয়ার ঘটনায় ভূমিকা রাখেন তিনি। বিধি অনুযায়ী প্রকল্পের দরপত্র গণপূর্তের ঢাকা সার্কেল-৩ থেকে আহ্বান ও তৎকালীন ঢাকা গণপূর্ত জোন থেকে মূল্যায়ন করার কথা থাকলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গণপূর্তের সদর দফতর থেকে ওই টেন্ডার আহ্বান করে জি কে শামীমকে কাজটি পাইয়ে দেন মঈনুল। ৫৫০ কোটি টাকার কাজে সমান সমান অথবা কিছু কমে নেওয়ার কথা। কিন্তু ১০ শতাংশ বেশিতে জি কে শামীমকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি।
৪. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ভবন নির্মাণে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প ৭.১৩ শতাংশ বেশিতে ঠিকাদারকে পাইয়ে দেন মঈনুল। এর বিনিময়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে ১৩.৫ শতাংশ হারে কমিশন নেন মঈনুল।
৫. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য বালিশসহ ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটার দুর্নীতির ঘটনায় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আসিফ হোসেন ও সাজিন কন্সট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. শাহাদাত হোসেনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ঘটনায় ঠিকাদার আসিফ ও শাহাদাত এবং ১১ জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গত ১২ ডিসেম্বর মামলা হয়। মামলার আসামিরা সবাই মঈনুল ইসলামের ঘনিষ্ট। মঈনুলের কারণে আসামিরা ৩১ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করতে পেরেছেন।
প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
১. অষ্টম জাতীয় সংসদের অনিয়ম, দুর্নীতি তদন্তে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়াকে (ডেপুটি স্পিকার) প্রধান করে সংসদীয় তদন্ত গঠন হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু ওই সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদফতর। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিন প্রকৌশলী ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। এই তিন প্রকৌশলীর একজন হলেন গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। ২০০২-২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনে উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
২. তিন দফা পদোন্নতি পেয়ে মোসলেহ উদ্দীনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করে কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম।
৩. তিন কোটি টাকা খরচ করে গত অক্টোবরে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহ উদ্দীন।
৪. গণপূর্ত অধিদফতরে কমিশন ভোগী হিসেবে পরিচিত মোসলেহ উদ্দীন। ফিফটিন পার্সেন্ট নামেও পরিচিতি রয়েছে তার।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ডিসেম্বর ১৭,২০১৯)