সাইদ খোকনের যত ভুল
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: মেয়র হানিফের পুত্র হিসেবে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মনোনয়ন বঞ্চিত হলেন সাইদ খোকন। তিনি যে মনোনয়ন পাচ্ছেন না তা স্পষ্ট হয়েছিল, যখন শেখ ফজলে নূর তাপস নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং মনোনয়ন ফরম কেনেন।
শেখ ফজলে নূর তাপস আওয়ামী লীগের একজন হেভিওয়েট নেতা। গত কিছুদিন ধরেই নানা কারণে তিনি আলোচিত। একজন ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি জনগণের কাছে পরিচিত। কাজেই শেখ ফজলে নূর তাপস প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি আওয়ামী লীগের হাই কমাণ্ডের সবুজ সংকেত পেয়েছেন এবং সাইদ খোকনের বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে।
প্রশ্ন হলো যে, সাইদ খোকন পাঁচ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেন এবং তিনি অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পুত্র। তারপরেও তিনি কেন এবার মনোনয়ন পেলেন না? তার ভুলগুলো কী কী?
একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মোটা দাগে সাইদ খোকনের বেশ কতগুলো ভুল ছিল। যে ভুলের কারণেই তিনি নিজের জনপ্রিয়তা যেমন হারিয়েছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগেও তার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়েছিল। যে কারণে আওয়ামী লীগ এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে সাইদ খোকনের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে শেখ ফজলে নূর তাপসকে বেছে নিয়েছে। সাইদ খোকনের ভুলগুলো কী কী সেটাই একবার দেখে নেওয়া যাক-
১. ব্যক্তিত্ব স্থাপন করতে না পারা
মেয়র হিসেবে সাইদ খোকন কোনো ব্যক্তিত্ব স্থাপন করতে পারেননি। একজন মেয়রকে বলা হয় নগরপিতা। একজন মেয়র নগরের অভিভাবক। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সাইদ খোকন নিজেকে আলাদাভাবে বিকশিত করতে পারেননি। নিজেকে পাদপ্রদীপে আনতে পারেননি। কখনোই তাকে নগরপিতা বা নগরের অভিভাবক হিসেবে মনে করেনি দেশের জনগণ। জনগণ যেন তাকে নগরপিতা মনে করে এবং তিনি নগরের অভিভাবক হতে পারেন এরকম কোনো আচার আচরণ বা দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডও তিনি দেখাতে পারেননি।
২. ঢাকা দক্ষিণের দৈন্যদশা
সাইদ খোকন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সময় অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঢাকা দক্ষিণকে আধুনিক, উন্নত এবং একটি পরিশীলিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে সাইদ খোকন তেমন কিছুই করতে পারেননি। বরং ঢাকা দক্ষিণ আরও জীর্ণশীর্ণ, হতদরিদ্র হয়েছে।
বিশেষ করে, দুই সিটি কর্পোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর আনিসুল হক এবং সাইদ খোকন একই সাথে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময় আনিসুল হক যেমন ঢাকা উত্তরে অনেক পরিবর্তনের আমেজ এনে দিয়েছিলেন, সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন দক্ষিণের মেয়র সাইদ খোকন। এই ব্যর্থতার দায় অবশ্যই তাকে নিতে হবে এবং এটা তার একটা বড় ভুল ছিল।
৩. দৃষ্টিভঙ্গীর দুর্বলতা
একটা উন্নত, আধুনিক নগরীর জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, সেটা কখনোই সাইদ খোকন দেখাতে পারেননি। তার দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব নগরবাসীকে বিরক্ত করেছে। নগরবাসী আশাহত হয়েছে। এটাও সাইদ খোকনের একটা বড় ভুল ছিল।
৪. নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে বন্দি হওয়া
সাইদ খোকন নগর ভবনের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে বন্দি হয়েছিলেন। সেখানে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানারকম দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়সময়ই উঠতো। এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাইদ খোকন সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
৫. ডেঙ্গু মোকাবেলায় ব্যর্থতা এবং ভুল তথ্য পরিবেশন
সাইদ খোকন ডেঙ্গু মোকাবেলার ক্ষেত্রে শুধু ব্যর্থতার পরিচয়ই দেননি, বরং ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য এবং অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড দেখিয়ে নগরবাসীর বিরক্তির উদ্রেক করেছিলেন। এ কারণে ঢাকা দক্ষিণের সাধারণ মানুষ ডেঙ্গু মোকাবেলায় সাইদ খোকন এবং সিটি কর্পোরেশনকে বেশি দায়ী করেছেন। এই ব্যর্থতা নিয়ে আগামী নির্বাচন মোকাবেলা তার জন্য কষ্টকর হতো। কাজেই ডেঙ্গু মোকাবেলায় ব্যর্থতা সাইদ খোকনের বড় ভুল ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মনে করেন।
৬. নেতা হিসেবেও ব্যর্থ
দলীয় টিকেটে নির্বাচিত একজন মেয়রের সাংগঠনিক কিছু দায়িত্ব থাকে। কিন্তু সাইদ খোকনকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং তিনি দলীয় কোন্দলে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। যে কারণে তিনি মেয়র হিসেবে সফল নাকি ব্যর্থ, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো তিনি নিজেকে একজন নেতা হিসেবে উদ্ভাসিত করতে পারেননি।
৭. জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারেননি
একজন মেয়রের কাছে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে যে তিনি ন্যায়নিষ্ঠ হবেন। যেকোনো সমস্যায় তিনি জনগণের পাশে দাড়াবেন। কিন্তু পুরান ঢাকা এলাকায় একের পর এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন রকম সমস্যাকে প্রায়ই তিনি উপেক্ষার চোখে দেখেছেন। সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য নগরবাসীকে সাথে নিয়ে দাঁড়াতেও তিনি পারেননি। এটাও তার একটি বড় ভুল ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
৮. সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা
একজন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে কাজ করার ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হয়। এই সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপিদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হয়। সাইদ খোকন সেটি করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। এমপিদের সঙ্গে তার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে এটাও তার একটি বড় ভুল।
এই ভুলগুলোর কারণেই মেয়র পদে সাইদ খোকন অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। নতুন মেয়র যে-ই হোন না কেন তিনি ঢাকা নগরীকে কীভাবে সাজাবেন সেটাই হলো দেখার বিষয়।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/ডিসেম্বর ২৯,২০১৯)