বঙ্গবন্ধুর সাথে আত্মকথন
এম. শাহনাজ বেগম দীপ্তি
[বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনের জন্য ক্ষণগণনা চলছে। শুরু হয়েছে এ দেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন আলোড়ন, চেতনার নতুন উন্মেষ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম , যারা স¦াধীন বাংলাদেশে জন্মেছে,যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেননি।তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তারা ফিরে পেতে চায় সেই মহান নেতাকে স্বপ্নে, জাগরণে। কখনো কখনো নেতার সঙ্গে কল্পনায় কথা বলেন। জানাতে চান দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা। এরকমই একজন তেজগাঁও মডেল হাই-স্কুলের সহকারি শিক্ষক শাহনাজ বেগম দীপ্তি। তার মননজুড়ে রয়েছেন স্বাধীনতার এই মহানপুরুষ। তার কল্পলোকে সারাক্ষণ বাস করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই কল্পলোকের নানা ভাবনা ও অনুভূতি সংলাপের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে এই লেখায়।]
দেশী : আসসালামু আলাইকুম। :
বঙ্গবন্ধু : ওয়ালাইকুম আসালাম।
দেশী : এসো, বসো। তোমার অপেক্ষাতেই যে, বসে আছি।
বঙ্গবন্ধু : তা কি ব্যাপার? আজ সকাল থেকেই তোকে এমন ফুরফুরে দেখাচ্ছে-
দেশী : ও মা দেখাবে না? তুমি জানোনা বুঝি? তোমার চেয়ে ভালো আবার কে জানে এ ব্যাপারে!
বঙ্গবন্ধু : তা আজ তোর প্ল্যান কি?
দেশী : কি আর করবো বলো! ভাবনা আমার বিশাল কিন্তু গণ্ডিটাতো ক্ষুদ্র।
বঙ্গবন্ধু : সমস্যা কি? ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত কর।
দেশী : সেটা কি চাট্টিখানি কথা? এ রাজাকারবেষ্টিত সোনার বাংলায়। কেন যে তুমি ওদের ক্ষমা করলে!
বঙ্গবন্ধু : কই আমিতো কুখ্যাত রাজাকারদের ক্ষমা করিনি।
দেশী : যাই বলো, ওই দু একটা বীজ যা পড়েছিল তা থেকেই ওদের এতদিনে এত বাড় বেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু : চেষ্টা কর। সবাই মিলে চেষ্টা কর। দেশ থেকে ওদের সমূলে উৎপাটিত কর।
দেশী : চেষ্টা করে যাচ্ছে তো তোমার প্রিয় হাসু।
বঙ্গবন্ধু : একা ও কতদিক দেখবে, তোরাও হেল্প কর।
দেশী : শোন বন্ধু, তোমার মেয়ে এখন রাষ্ট্র প্রধান তাঁর কাছে আমার বার্তা পৌঁছাবো কিভাবে?
বঙ্গবন্ধু : আরে বলে কি? আমি এতবড় একটা কাজ সম্পন্ন করে তোদের দিয়ে আসলাম আর তোরা এটুকু পারবি না?
দেশী : বন্ধু তোমার ৭ই মার্চের আহবানে এ দেশের সকল মানুষ সাড়া দিয়েছিল কিন্তু তুমি তো তুমি- অনন্য। তুলনাহীন একজন।হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী।
বঙ্গবন্ধু : তোরা বুঝি আমার এ নাম দিয়েছিস?
দেশী : হ্যাঁ দিয়েছিতো। কিন্তু তাতে কি- তোমাকে কি বলে ডেকে যে আমরা পরিতৃপ্ত হব তার ভাষা খুঁজে পাইনা।
বঙ্গবন্ধু : বড় শান্তি পেলাম রে।
দেশী : না-না বন্ধু তোমার সোনার বাংলা যতদিন গড়তে না পারবো ততদিন আমরা শান্তি পাবো না।
বঙ্গবন্ধু : শোন আমি তোদের সব খবর অল্প বিস্তর রাখি। দেশটাকে কিন্তু আমার হাসু মা অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে।
দেশী : হ্যাঁ। কিন্তু সেখানে অনেক কাঠ খড় কিন্তু তাঁকে পোড়াতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ। আমি জানি। কারণ প্রকৃত দেশপ্রেম এখন আর আমি মানুষের মধ্যে আগের মত দেখছি না। সব শুধু আসে নিজের পকেট ভারী করার জন্যে।
দেশী : ঐ যে বললাম না চারদিকে রাজাকারদের বাড়-বাড়ন্ত। যাদের মুখে বঙ্গবন্ধু অন্তরে গোলাম আযম। দেখ তুমি যাদেরকে ভালোবেসে রাজনীতিতে এনেছিলে তাদের হাতেই তুমি জীবন দিলে। তারপর দীর্ঘ একুশ বছর তোমার প্রিয় বাঙালী জাতি তোমার নামটি পর্যন্ত নিতে ভয় পেত। দেখ আমার কথাই বলি- আমার জন্ম ১৯৭০ খ্রীঃ এর মার্চ মাসে। অথচ আমি তোমার বিখ্যাত ভাষণটি প্রথম শুনেছি কিন্তু ১৯৯৬ সালে। তাহলে বোঝ ব্যাপারটা! ঘাতক দালাল এবং তার অনুসারীরা এই একুশ বছরে বাংলাদেশটাকে আবার প্রায় পাকিস্থানে পরিণত করতে যাচ্ছিল। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমরা প্রাণ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু ততদিনে জল অনেকদূর গড়িয়েছে।
প্রায় দুটো প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এদেশে পাকিস্থানি মনোভাব নিয়ে। তারা গান ভালোবাসে না। কবিতা পড়ার সময় তাদের নেই। পড়ালেখায় মনোযোগ নেই, দেশপ্রেম বোধ নেই- আছে শুধু অনাসৃষ্টি নিয়ে। বদ্ধঘর আর উন্মুক্ত আকাশের পার্থক্য তারা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। তারা চোখ মেলে দেখে না বর্ষার আকাশ আর শরতের আকাশের পার্থক্য। তারা বোঝে না শীতের পরে বসন্ত কোন আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে? মন ও মণনশীলতা আমি তাদের মধ্যে খুঁজে পাই না। ওরা শুধু পয়সা চিনেছে। ওদেরই বা দোষ কি বল? ওরা যা দেখছে তা-ই শিখছে।
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ তোর সব কথাই ঠিক আছে। এই ফাঁকে তোর কথার মাঝে আমি কিন্ত ুএকটি জিনিস জেনে গিয়েছি।
দেশী : কি?
বঙ্গবন্ধু : তোর জন্ম মার্চ মাসে-তাই।
দেশী : ওমা এ আর এমন কি? প্রতি মুহুর্তেই তো পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু : সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমার আনন্দ অন্য জায়গায়।
দেশী : কি সেটা?
বঙ্গবন্ধু : এই মার্চেই কিন্তু আমরা অনেক কিছু পেয়েছি।
দেশী : হ্যাঁ। ৭ই মার্চ, ১৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ পেয়েছি তো। সে আনন্দ তো আমাদের আছেই।
বঙ্গবন্ধু : ১৭ই মার্চটা আবার কি?
দেশী : ওমা এরই মধ্যে আবার ভুলে গেলে? অবশ্য তুমিতো কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবোনি।
বঙ্গবন্ধু : কি আবার ভুলে গেলাম?
দেশী : আরে বা এটা জানবে না?১৭ই মার্চ আমরা কত আনন্দ করি। কেন বলতো?
বঙ্গবন্ধু : ও সবে আমার মাথা ব্যথা নেই।
দেশী : হ্যাঁ তাতো জানি। তুমি বিনয়ের সাথে বলতে- ““আমি একটা মানুষ, আমার আবার জন্মদিন”।
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ- ঠিকই তো বলতাম।
দেশী : শোন বন্ধু, তুমি চাইতে না ঠিকই। কিন্তু তোমার কীর্তি তোমাকে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
বন্ধু : যা-যা তোকে আর আমাকে এত খুশী করতে হবে না। তোরা আনন্দে শান্তিতে থাক। তাহলে আমি শান্তি পাবে।
দেশী : জানো বন্ধু তোমার লেখাগুলো পড়ে আমি খুব কষ্ট পাই।
বঙ্গবন্ধু : কেন রে?
দেশী : আরে বা- তুমি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী থেকেছো, ঠিকমত খেতে পারোনি, ঘুমাতে পারোনি- ভালো একটা পোশাকও কোনদিন পরনি,এদেশের দুঃখী মানুষের কথা ভেবে। অথচ আজ আমরা তোমার অর্জিত দিবসগুলো নিয়ে কত আনন্দ করি। কত রং মিলিয়ে, ভাবনা মিশিয়ে, চেতনা নিয়ে পোশাক পরি।
বঙ্গবন্ধু : আমার প্রিয় পতাকার রঙ, শ্যামল বাংলার রং সেখানে ঠাঁই পায় তো?
দেশী : হ্যাঁ। অবশ্যই পায়। এই যে দেখ- আজ ১৭ই মার্চ তোমার জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন করছি আমরা। চারিদিকে আনন্দ আর খুশীর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু : তা- তুই কি রঙের শাড়ী পরেছিস রে?
দেশী : কেন দেখতে পাচ্ছো না বুঝি লাল-সবুজ মিলিয়ে? কারন তোমার চেতনার সবটুকুতেই ছিল দেশপ্রেম- আর এদেশের রং তো লাল-সবুজ।
বঙ্গবন্ধু : তোর বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ টা আগে ভালো লাগতো। এখন আর অত সুন্দর নেই।
দেশী : তুমি কিভাবে জানলে?
বঙ্গবন্ধু : জানবো না? আমি কি তোদের ছেড়ে থাকতে পারি? আমার বিচরণ তো এই দেশকে ঘিরেই।
দেশী : হ্যাঁ ঠিকই বলেছো। তোমার সোনার বাংলার মানুষগুলো এখন তামাটে হয়ে গেছে। তারা গাছপালা নিধন করে শুধু ইমারত বানায়। শুধু আমাদের বিদ্যালয় কেন? সারাদেশে বৃক্ষ নিধন, ইমারত নির্মান, নদী ভরাট, স্থাপনা নির্মান যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখানে নেই খোলা মাঠ, প্রান্তর যেখানে শিশুরা বিচরণ করবে।
বঙ্গবন্ধু : আমি তো তোদের আগেই বলে আসছিলাম মানুষ খনিতে নানা রকম প্রাকৃতিক সম্পদ পায় আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। কারণ যে টাকা একটি অর্থবছরে আমার হাসু বরাদ্দ দেয় যদি তার সুষ্ঠু ব্যবহার হতো তাহলে অর্ধেক টাকায় দেশ আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতো।
বঙ্গবন্ধু : নাও এখন একটু চুপ করে আরাম করে বসতো।
বঙ্গবন্ধু : আর আরাম! সারা জীবন কারাগারে বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছি। তো নির্মল আনন্দ জীবনে পাইনি বললেই চলে।
দেশী : তা পাবে কি ভাবে? সারা জীবনতো শুধু মানুষের আরামের চিন্তা করে গেলে।
বঙ্গবন্ধু : তা না করলে তোরা ভালোভাবে বাচঁতে পারতিস?
দেশী : সেটাই উচিৎ ছিল এদেশের বেঈমানদের জন্য।
বঙ্গবন্ধু : কি সেটা?
দেশী : ঐ যে, পরাধীন দেশে পাকিস্তানীদের প্যাদানি খেয়ে সোজা হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু : ও কথা আর মনে করিস না। ওগুলো মনে হলে কষ্ট পাই। আমার কত মানুষের জীবন ওরা নির্মম ভাবে কেড়ে নিয়েছে। আমার আবার যাবার সময় হয়ে এলো।
দেশী : ও কথা বলো না তো। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তুমি ছাড়া আর কে আমার কথাগুলো শুনবে বলতো?
বঙ্গবন্ধু : শুনবে শুনবে। চেষ্টা করে যা আমার স্বপ্নগুলো, কথাগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দে। এটা তোদের দায়িত্ব।
দেশী : দোয়া কর যেন সফল হই। একটু বস। তোমার জন্য পায়েস নিয়ে আসছি খাবে।
বঙ্গবন্ধু : কেন? আবার পায়েস কেন? অনেক কিছু তো খেলাম।
দেশী : কেন জন্মদিনে আমার হাতের একটু পায়েস খাবে না?
বঙ্গবন্ধু : নিশ্চয়ই খাবো। দে-দে।
দেশী : স্বাদ হয়েছে?
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, খুব মজা।
দেশী : মিথ্যে বলো না তো। তোমার মায়ের হাতের পায়েস কি আমি রাঁধতে পারি? সেই দেশী গরুর দুধই বা পাবো কোথায়?খেজুরের পাটালীই বা পাবো কোথায়?ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো- আর কি। সব ভেজাল খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। নাও খাইয়ে দেই।
বঙ্গবন্ধু : নে তুই হা কর।
দেশী : দাও দাও দুই বার দিও কিন্তু।
বঙ্গবন্ধু : কেন এ আবার কি নিয়ম?
দেশী : একবার খাওয়ালে নাকি পানিতে পড়ে যায় তাই।
বঙ্গবন্ধু : হা-হা-হা দেশে পানি-ই-তো নাই। আবার পানিতে পড়বি কিভাবে?
দেশী : ও বন্ধু। তুমি আবার আরেক দুঃখের কথা মনে করলে। ভূমিদস্যুরা এদেশের নদীগুলোকেও রেহাই দিচ্ছে না যে। প্রশাসনের নাকের ডগায় যার যা খুশী তাই করছে।
বঙ্গবন্ধু : তোরা ঐক্যবদ্ধ হ। সকল প্রকার অন্যায় থেকে দেশটাকে উদ্ধার কর। তা চললাম রে- ভালো থাকিস।
দেশী : আবার এসো।
বঙ্গবন্ধু : আসবো কিরে? আমি তো তোদের সাথেই আছি।
দেশী : আসসালামু আলাইকুম।
বঙ্গবন্ধু : ওয়ালাইকুম আসসালাম।
দেশী : বিদায়।
বঙ্গবন্ধু : বিদায়।