২৭৫ কোটির অবৈধ সম্পদ; বাড়ি বরিশাল, কে এই পিকে?
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় পৌনে তিনশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া তাঁর নিজের ও স্বজনদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে এক হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মূল্যায়ন, এটা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ২০ জনের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং পাসপোর্ট আটকানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি (পিকে হালদারের দখলে থাকা) ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।
দুজন বিনিয়োগকারীর টাকা ফেরত-সংক্রান্ত এক আবেদনের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট শাহরিয়ার কবির।
এদিকে আজ মঙ্গলবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ও তার স্ত্রী, মা, দুই চাচাতো ভাই, এক বন্ধুর সব সম্পত্তি ক্রোক, ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দুদক বলছে, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হলে কমিশন সেটা যাচাই-বাছাই শেষে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়।
গত সেপ্টেম্বরে দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। এর পরপরই গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও অন্যান্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় আয়পূর্বক বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত যেসব অভিযোগ আসে, এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর প্রথম তালিকায়ই প্রশান্তের নাম ছিল।
দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদারের নামে-বেনামে ১৮৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। আর অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৯৯ কোটি ৬১ লাখ দুই হাজার ৯২৫ টাকার। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকার। অনুসন্ধানের সময় পাওয়া তথ্য মতে, ২০১৮ সালে তাঁর বার্ষিক মূল বেতন ছিল ৪৮ লাখ টাকা। এই হিসাবে ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বৈধ আয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এটা বাদ দিলে তাঁর কাছে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ আছে।
মামলার বিবরণে বলা হয়, প্রশান্ত কুমার হালদারের নিজ নামে ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময় প্রায় এক হাজার ৬৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা করেছেন। বিশাল ওই টাকার মধ্যে নিজের পরিচালিত হিসাবেই ২৪০ কোটি টাকা জমা হয় এবং তাঁর মা লীলাবতীর নামে পরিচালিত হিসাবে ১৬০ কোটি টাকা জমা হয়। প্রশান্তের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন সময়ে এক হাজার ২৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়।
এ ছাড়া প্রশান্তের নামে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে। নামে ও বেনামে আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁর। দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রশান্ত কুমারের নামে এত বিপুল সম্পদ অর্জনের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। এসব সম্পদের বেশির ভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের এজাহারে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের সময় প্রশান্তকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি হাজির হননি। তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে তথ্য আছে।
মামলার বিবরণে আরো বলা হয়, অস্তিত্ববিহীন বিভিন্ন কাগুজে কম্পানির মাধ্যমে বেনামি লিপরো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ১২৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশান্ত কুমার হালদার ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৯টি দলিলের মাধ্যমে ভালুকা উপজেলার হাতীবেড় এবং উথুরা মৌজায় ৫৮৯ শতক জমি নিজ নামে কিনেছেন, যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। এসব সম্পত্তি কেনার বৈধ কোনো আয়ের উৎস খুঁজে পায়নি দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রশান্ত কুমার হালদারের আয়কর নথি ও অন্যান্য নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁর নিজ নামে ৩২ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। ওই সব অস্থাবর সম্পদের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট আয়ের কোনো বৈধ উৎস পায়নি দুদক। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এবং ছলচাতুরির মাধ্যমে ভুয়া নাম ব্যবহার করে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড ও পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড কম্পানির নামে ওই সব অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ দেখানো হয়। এ ছাড়া সুখাদা লিমিটেড, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আজিজ ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ক্লীউইস্টন ফুড অ্যান্ড অ্যাকোমোডেশন লিমিটেড, জেডএ অ্যাপারেলস লিমিটেড, উইনমার্ক লিমিটেড, রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড, আর্থস্কোপ লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডসহ বিভিন্ন কম্পানিতে প্রশান্ত নিজের নামে এবং বেনামে বিনিয়োগ করেন এক শ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই সব কম্পানিতে বিনিয়োগ করা টাকা প্রশান্ত কুমার হালদারের। তিনি নিজে, তাঁর ঘনিষ্ঠ স্বজন ও কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে এসব টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এসব টাকা বিনিয়োগের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈধ আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি প্রশান্ত কুমার হালদার।
প্রশান্ত কুমার হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তাঁর মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রশান্ত কুমার হালদার ও প্রিতিশ কুমার হালদার, দুই ভাইই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন প্রশান্ত কুমার হালদার। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
জানা গেছে, দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে, যার অন্যতম পরিচালক প্রিতিশ কুমার হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাঁদের কার্যালয়।
আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাঁদের।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জানুয়ারি ২১,২০২০)