১৫ বছরেও বিচার হয়নি কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি: সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৫ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ সংগঠন ও কিবরিয়া স্মৃতি পরিষদ। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ বছর পর সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হলেও বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। হামলায় আরও নিহত হন শাহ এএমএস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী। আহত হন কমপক্ষে শতাধিক নেতাকর্মী।
ঘটনার রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা।
সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আদালত আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে তৎকালীন সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করেন। এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করেন। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল।
২০১১ সালের ২৮ জুন শাহ এএমএস কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জ্যুডিসিয়াল আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জ্যুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। নতুন আসামিরা হলেন- সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া।
এরপর, ২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। এর পর থেকে সেখানে বিচার কাজ শুরু হয়।
মামলায় মোট আসামি ৩২ জনের মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ আসামির ফাসি কার্যকর হয়েছে। এখন এখন ২৯ জন আসামি রয়েছে। এর মধ্যে জামিনে আছে ১২ জন। পলাতক ৭ জন এবং হাজতে ১০ জন। বর্তমানে সিলেটে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এখন পর্যন্ত ৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
নিহত আব্দুর রহিমের কন্যা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘আমরা ১৫ বছর ধরে পিতৃহারা। ১৫ বছরের বিচারের মুখ দেখতে পারলাম না, বিচার হবে কিনা সন্দেহ আছে। বর্তমান সরকারের আমলেই বাচার হত্যার বিচার দেখতে চাই।’
নিহত সিদ্দিক আলীর ছেলে কদ্দুছ মিয়া জানান, ‘১৫ বছর ধরে বিচার পাই নাই। এ সরকারের আমলে বিচার না হলে বিচার পাবো না, আশা ছেড়ে দিয়েছি।’
মামলার বাদী ও আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এমপি বলেন, ‘বিচার নিয়ে আমি হতাশ নই। কেননা এ দেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার হয়েছে। কাজেই কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারও হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিমিনাল কোর্টের মামলায় অনেক সঙ্গত কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ পিছিয়ে যায়।’
প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া মামলার প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখনও ঠিকমত তদন্ত হয়নি এবং তিনটি মিথ্যা চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনও সম্পর্ক নেই। দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তদন্তকারী কর্মকর্তারা দিতে চাননি। আসল মদতদাতা কারা এবং গ্রেনেডের উৎস্য কী- প্রশ্ন দুটির উত্তর সরকার কখনও দিতে চায়নি। আমরা ২০০৫ সাল থেকে বলে আসছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যা তদন্তের ভিত্তিতে কোনও চার্জশিট আমরা মানি না এবং মিথ্যা তদন্তে বিচার হলে মানব না।’
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/জানুয়ারি ২৭,২০২০)