এপ্রিল ফুল কী এবং কেন?
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: কোনো এক বন্ধুকে একদিন বিশেষভাবে শিক্ষা দিতে বা প্রতিশোধ নিতে চান, অনেকদিন থেকেই সেই সুযোগে আছেন কিন্তু পারছেন না। মনে হলো এপ্রিল ফুলের কথা, এই দিনে সবাই তো সবাইকে বোকা বানিয়ে ভড়কে দেয়। তাহলে সত্যমিথ্যা মিলিয়ে এই এপ্রিলের প্রথম দিনটিতে বন্ধুকে কোথাও নিয়ে বা সবাই মিলে এমনকিছু করলেন যাতে যে হয়ত খুব চমকে গেলো, অপদস্ত হলো। আর আপনি তাকে ‘এপ্রিল ফুল’ বানিয়ে খুব মজা পেলেন।
কোনো একটি সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট উৎসব বা রীতি থেকে আধুনিক ‘এপ্রিল ফুল’ শুরু হয়েছিল-এমনটা মনে করেন অনেক ইতিহাস গবেষকই। এ দিবসের প্রেক্ষাপট না জেনেই এর চর্চা করা হচ্ছে। নিজেরা যেমন এ অপসংস্কৃতির সঙ্গে জড়াচ্ছি। এপ্রিল ফুল দিবসের ইতিহাস যারা জানেন তারা এ দিবসটি পালন করেন না। বরং দিবসটি পালনকে বড় অন্যায় বলে স্বীকার করেন।
এপ্রিল ফুল এলো কীভাবে
এপ্রিল ফুল শব্দের অর্থ, দিবসের সূচনাকাল, প্রেক্ষাপট, মুসলিমদের সঙ্গে এ দিবসের সম্পর্ক ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, দিবসে কী করা হচ্ছে, করণীয়-বর্জনীয় ও তথ্যের ভিত্তিসহ নানা দিক আমাদের জানা দরকার। এসব কিছু জানার পর তা মেনে চলাই জ্ঞানীর কাজ।
‘এপ্রিল ফুল’ সম্পর্কে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে ভুল ইতিহাস প্রচলিত। মুসলমানদের আবেগকে পুঁজি করে একটা শ্রেণী ছড়িয়েছে যে, ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল স্পেনের মুসলমানদেরকে মসজিদে অবরুদ্ধ করে ধোঁকা দিয়ে পুড়িয়ে মারে রাজা ফার্দিনান্দ, তার সঙ্গে ছিলেন রানী ইসাবেলা। এই ধারণাটি সবখানে বেশিমাত্রায় প্রচলিত। কিন্তু ইতিহাস বলে, ঐ ঘটনারও বহু আগ থেকেই ঐতিহাসিকভাবে ‘এপ্রিল ফুল’ পালিত হতো।
ধারণা করা হয়, ইউরোপে এপ্রিল ফুলের প্রসার ফ্রেঞ্চ জাতির মধ্যে। ফ্রেঞ্চরা ১৫০৮ সাল, ডাচরা ১৫৩৯ সাল থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে কৌতুকের দিন হিসেবে পালন শুরু করে। ফ্রান্সই প্রথম দেশ হিসেবে সরকারিভাবে নবম চার্লস ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন । অর্থাৎ তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালীয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী প্রবর্তিত গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। পাশাপাশি ১ এপ্রিল বন্ধুদের উপহার আদানপ্রদানের প্রথা বদলে যায় ১ জানুয়ারি। কারণ তখন বিভিন্ন দেশে জুলিয়ীও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউইয়ার পালিত হত ১ এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই তাদের পুরনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ১ জানুয়ারির পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাঁকি দিতে ১ এপ্রিলে ভুয়া উপহার পাঠানোর প্রথা চালু করে।
ফ্রান্সে কাউকে বোকা বানালে বলা হত এপ্রিল মাছ (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় poisson d’avril. এই্ নামকরণের কারণ, রাশিচক্র অনুযায়ী স্বর্গের কাল্পিক রেখা অতিক্রম করলে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত।
ডাচদের আরও কারণ রয়েছে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিল তারা নিজেদেরকে গুইযেন বা ভিখারী বলে পরিচয় দিত । ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোট শহর ডেন ব্রিয়েল করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেষ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান বা দ্যা ডিউক অব অ্যালবা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। সেই থেকে দিনের প্রচলন।
এপ্রিল ফুলের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে, দিয়েছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জোসেফ বসকিন। এই প্রথাটির শুরু হয় রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের শাসনামলে। হাসিঠাট্টা নিয়ে মেতে থাকে এমন একদল বোকা গোপাল ভাঁড়েরা সম্রাটকে কৌতুক করে বলে, তারা রাজার চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবে। রাজা খুশি হলেন। রাজা গোপাল ভাড়দের সর্দার কুগেলকে একদিনের জন্য বাদশাহ বানিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। আর কুগেল সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজ্যে আইন করে প্রতিবছরের এইদিনে সবাই মিলে তামাশা করবে। অধ্যাপক বসকিন আরও বলেন, প্রাচীন ওই সময়ের মারাত্মক দিনগুলোতে রাজাদের দরবারে কিন্তু বোকারুপীরাই ছিল প্রকৃত জ্ঞানী। তারা মজা বা হাসিঠাট্টার মাধ্যমে অনেক কাজ কৌশলে হাসিল করে নিত বা জ্ঞানের কথা রসালোভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিত।
বসকিন মূলত আগের সব ব্যাখ্যাকে উড়িয়ে দেন। ১৯৮৩ সালে বার্তা সংস্থা এপি পরিবেশিত বসকিনের এই ব্যাখ্যাটি অনেক কাগজে নিবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। আর্টিকেলটি ছাপানোর আগে এপি দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেছে তারা নিজেরাই এপ্রিল ফুল বোকামীর শিকার হচ্ছে না তো!
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কাউকে বিভিন্নভাবে বোকা বানানোর প্রথা চালু রয়েছে। রোমানদের হিলারিয়া উৎসব এর মধ্যে অন্যতম। তারা মার্চের ২৫ তারিখে আট্টিসের পূনরুত্থান নিয়ে এইদিনে হালকামি করত, ইহুদীরা করত পুরিম উপলক্ষ্যে।
সাধারণদের কাছে এপ্রিল ফুল
আমাদের সাধারণদের কাছে এপ্রিল ফুল খুব জরুরি কোনো দিন নয়, তবে এটা শুধু মজা বা কাউকে ভড়কে দেওয়ার একটা মানসিকতা মূলত। আমাদের বেশিরভাগই কিন্তু এর বাস্তব ইতিহাস না জেনেই গা ভাসিয়ে দেই বলা যায়। অন্যকে বোকা বানানোই এর মূল উদ্দেশ্য। মজা, বোকা বানানো সেটা জীবনের অংশ হতে পারে। সেটা নিছকই আনন্দ লাভের তাগিদে, সম্পর্কের মাপকাঠি বুঝে। কিন্তু একটা মানুষকে এই দিনে কঠিন কোনো মজা বা মিথ্যা দিয়ে একেবারে ভড়কে দেওয়া কখনো সমীচীন হয় না।
মজা আনন্দের জন্য তো কোনো বিশেষ দিন আমাদের না হলেও চলে। সেখানে কোনো ছক কষে কাউকে ঘাবড়ে, কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়ে আনন্দ নেওয়াটা সুস্থ মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতেই পারে।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০১এপ্রিল,২০২০)