সর্দি জ্বর শ্বাসকষ্ট নিয়ে ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১১
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: করোনাভাইরাসের লক্ষণ সর্দি, জ্বর ও কাশি নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের বেশ কয়েকজন হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩, চট্টগ্রামে ২, বগুড়ায় ১, শরীয়তপুরে ১, ফেনীতে ১, সাতক্ষীরায় ১, খুলনায় ১ ও নড়াইলে ১ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুবরণের পর তাদের কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। লাশ দাফন নিয়েও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে।
সারা দেশের প্রতিনিধিদের তথ্যানুসারে, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে গতকাল ভোরে জ্বর, সর্দি, কাশি ও হাঁচি নিয়ে এক নারী মারা যান। উপজেলার বন্দকাটি গ্রামে বাবার বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। ওই নারীর নাম রাশিদা খাতুন (২৫)। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের ফতেপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী। ২৬ মার্চ সন্ধ্যার দিকে রাশিদা খাতুনের জ্বর শুরু হয়। ২৭ মার্চ তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে বন্দকাটি গ্রামে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। ২৮ মার্চ স্থানীয় পল্লী চিকিৎসককে দেখান। কিন্তু সুস্থ না হওয়ায় স্থানীয় একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মারা যান রাশিদা। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি থাকা ১৩ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকালে ভর্তি হওয়া শিশুটি সন্ধ্যা ৭টায় মারা যায়। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান গ্রামের ওই শিশুটি খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর চিকিৎসাকালেই তার মৃত্যু হলো। বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজল জানান, শিশুর সাত দিন ধরে দুই পায়ে ব্যথা এবং তিন দিন ধরে জ্বর ছিল। বুধবার সকাল থেকে শ্বাসকষ্ট ছিল তার।
চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) আইসোলেশনে থাকা প্রায় ৬০ বছর বয়সী এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে তিনি মারা যান। মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে বিআইটিআইডিতে এক রোগীকে পাঠানো হয়। ওই রোগী আগে থেকেই ডায়াবেটিস ও হাঁপানিসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। তাই তাকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে তার কোনো জ্বর বা সর্দি ছিল না। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ‘নিউমোনিয়ার উপসর্গ ও শ্বাসকষ্ট’ নিয়ে গতকাল সকালে মৃত্যু হয়েছে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরের। তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছিল কি না পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরের বাবাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।
ফেনীতে গতকাল দুপুরে করোনার উপসর্গ নিয়ে মোহাম্মদ রিপন (৩০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রিপন সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নে পশ্চিম ছনুয়া গ্রামের সুজা মিয়ার ছেলে। তিনি এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, পেটে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তার দেহে করোনাভাইরাস আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এছাড়া রাজধানীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে থাকা দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে ও গতকাল ভোরে তাদের মৃত্যু হয়। লাশ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে। তবে সন্দেহ করা হচ্ছে তারা দুজনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। এ জন্য তাদের রক্তের নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এদের দুজনের বয়স ৬৫ ও ৩২ বছর। তারা দুজনই পুরুষ। তাদের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা ছিল। করোনাভাইরাসের লক্ষণ থাকায় যাদের হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছিল। দুই মৃতদেহ থেকে নমুনা পাঠানো হয়েছে আইইডিসিআরে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কি না। আইইডিসিআর থেকে রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ এলে তাদের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। আর যদি করোনা পজেটিভ আসে তাহলে যথাযথ পদ্ধতিতে লাশ দাফন করা হবে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একজন রোগী মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তিটি পুরুষ। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। মঙ্গলবার দুপুরেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যার দিকে তিনি মারা যান। ওই রোগী প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। কুর্মিটোলা ওই রোগীকে সোহরাওয়ার্দীতে পাঠিয়ে দেয়। ওই রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি। তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, মৃত্যুর পর তার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে শিশু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শরীয়তপুরে মঙ্গলবার রাতে ঠা-া, জ্বর ও কাশি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির তিন ঘণ্টা পর এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ৩৫ বছর বয়সী ওই যুবক বালু উত্তোলন খননযন্ত্রের শ্রমিক। তার বাড়ি নড়িয়া উপজেলায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাকে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। জ্বর, কাশি ও গলাব্যথা থাকায় তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরা সুরক্ষা পোশাক পরে সদর হাসপাতাল থেকে ওই মরদেহ দাফনের জন্য নিয়ে যান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই যুবকের লাশ নড়িয়ায় তার গ্রামে নিয়ে গেলে দাফনকাজে বাধা দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খবর পেয়ে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশ নিয়ে স্থানীয় কবরস্থানে লাশ দাফন করেন।
নড়াইলে সর্দি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে শওকত হোসেন (২৫) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টার দিকে তাকে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা শেষে ওয়ার্ডে নেওয়ার আগেই রাত ৯টার দিকে তিনি মারা যান। শওকত নড়াইল পৌরসভার দক্ষিণ নড়াইল গ্রামের ওমর আলীর ছেলে। মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে তড়িঘড়ি করে তাকে স্থানীয় সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয়। শওকতের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পর শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের স্কুলছাত্র রিফাত চিকিৎসা না পেয়ে মঙ্গলবার মারা গেছে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রিফাতের শারীরিক সমস্যা মঙ্গলবার দুপুরের দিকে প্রকট হয়ে ওঠে। তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একে একে চারটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হয়। কিন্তু কেউ তাকে ভর্তি নেয়নি। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যায় রিফাত মারা যায়। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে খুলনা মহানগরীর গোয়ালখালী কবরস্থানে রিফাতের লাশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ফলাফল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এক সরকারি কর্মকর্তাকে ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আনা হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) পরিয়ে তাকে ঢাকায় আনা হয়। এদিকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আমতলী উপজেলার চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। করোনার লক্ষণ নিয়ে বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আট বছরের এক শিশু এবং ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আইইডিসিআর জানিয়েছে, তাদের শরীরে কোনো করোনাভাইরাস নেই।
জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে : ফরিদপুরে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ঘটনার পর ওই গ্রামের চারটি বাড়ির সদস্যদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে প্রশাসন। লক্ষ্মীপুরে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত একজনকে মঙ্গলবার থেকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন নিউমোনিয়ার এক রোগী। গতকাল এই দুজনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইসিডিআরে আনা হয়। জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি রোগীর বেশির ভাগই হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় গতকাল সন্দেহভাজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি আত্মগোপন করেছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তির বাড়ির আশপাশের আটটি পরিবারকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। ভোলা সদর হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন ইউনিট থেকে গতকাল এক রোগী পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তি জয়পুরহাট জেলার বাসিন্দা। তিনি স্থানীয় এক ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করেন। মঙ্গলবার রাতে ওই রোগী জ্বর ও কাশি নিয়ে ভর্তি হন। গতকাল দুপুর থেকে তাকে হাসপাতালে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভোলা সদর হাসপাতালে করোনা সন্দেহে আইসোলেশন ইউনিটে একজন রোগী ভর্তি রয়েছেন।
(দ্য রিপোর্ট/আরজেড/০২এপ্রিল,২০২০)